আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এই বাজেট উপস্থাপনের দিনই বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেল, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
তবে এটাই খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র নয়। লুকানো খেলাপি ঋণ বরং এর চেয়ে অনেক বেশি। অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা অর্থ ধরলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ হবে সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকার মধ্যে। নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ও ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষকে সারা বছর ধরে যত বড় করের বোঝা মাথায় নিয়ে টিকে থাকতে হবে, ঋণখেলাপিরা ইতিমধ্যে সেই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আরাম–আয়েশে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। একজন সাধারণ মানুষকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়, আর এসব ঋণখেলাপি চাইলে এখন থেকে ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে তাঁদের কালোটাকা সাদাও করতে পারবেন।
আত্মসাৎ করা অর্থ সাদা না করলেও কোনো সমস্যা নেই। ঋণখেলাপিদের জন্য নিত্যনতুন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তো আছেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সম্ভবত খেলাপি ঋণ ‘মোটাতাজাকরণ’ নামে একটি কর্মসূচি আছে। এই কর্মসূচি যে ব্যাপক সফল হচ্ছে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। কেননা মাত্র তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এ জন্য প্রথমেই অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশ ব্যাংককে। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ ৯ থেকে ১১ শতাংশ করা মুখের কথা নয়।২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন ২ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক স্পর্শ করতে মাত্র ১৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা বাকি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে গতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে, তাতে খুব বেশি সময় আর লাগবে বলে মনে হচ্ছে না।
যদিও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই বলা আছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইন প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আদায় নয়, বরং বৃদ্ধিটাই অব্যাহত থাকছে।আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে, ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। তবে ঘটছে উল্টোটা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। এ নিয়ে সব মহল থেকে উদ্বেগ দেখানো হলেও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত বৃহস্পতিবার যে বাজেট দিয়েছেন, তাতে এ নিয়ে একটা কথাও বলেননি; বরং মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক নীতি বিবৃতিতে আশঙ্কা করা হয়েছে যে খেলাপি ঋণ কমানোর প্রক্রিয়ার সুফল পেতে সময় লাগবে।
গতকাল শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে খেলাপি ঋণের অব্যাহত বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টার কথাই কেবল বলেছেন। আরও বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণের সমস্যা এক দিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরেই নানা কারণে হয়েছে।’ এই দীর্ঘদিনের বড় অংশই আসলে গত ১৫ বছর। এ সময়েই খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, সরকারের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে।
যেভাবে একের পর এক ছাড়
গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের পর প্রথমেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
এরপর করোনা শুরু হলে সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয়। এ সময় কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ২০২২ সালের জুলাই মাসে। এসেই তিনি ঋণখেলাপিদের গণ ছাড় দিয়ে নতুন এক নীতিমালা জারি করেন। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃ তফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকমালিকেরাই ঠিক করছেন কোন ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা পাবে। আগে ঋণ পুনঃ তফসিলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এর ফলে খেলাপি ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়েছে।
ছাড় দেওয়া এখানেই শেষ নয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল করা হয়। সর্বশেষ ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে আরও এক দফা ছাড় দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেয়, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। এতে ঋণখেলাপি কোম্পানির নতুন ঋণ পাওয়ার দরজা খুলে যায়। এত সব ছাড় দেওয়ার কারণেই প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এই সরকারকে ‘খেলাপিবান্ধব’ সরকার বলতেন।বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নিয়েই ঋণখেলাপিদের যখন গণ ছাড় দেন, তখনই প্রকৃত বার্তা পেয়ে গিয়েছিলেন প্রভাবশালীরা। সবাই তখন বুঝে যান খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর কোনো নীতি নয়, বরং ছাড়ই চলতে থাকবে। আর তার ফলাফল হচ্ছে খেলাপি ঋণের এত বড় লাফ।
আইএমএফ যা বলেছিল
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে একটি দীর্ঘ মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক। এখানে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তাঁরা।’
এর পরের চার বছরে পরিস্থিতির যে কোনো বদল হয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। ফলে খেলাপিও বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যাংক খাতের সমস্যা কমাতে বাংলাদেশ একটি রোডম্যাপ বা পথনকশার ঘোষণা দিয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। সেই পথনকশায় বহু বছর ধরে ব্যাংক খাতে যেসব সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তা রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই পথনকশা এরপর আর আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিশ্চুপ। অর্থাৎ নীতিনির্ধারক আর প্রভাবশালীদের যে গোপন আঁতাত, সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়েও আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণও দেখা যাচ্ছে না।