মগবাজারের আহমেদ পরিবার গলির মাথায় একটি পাঁচতলা ভবন। তৃতীয় তলায় আরণ্যক নাট্যদলের মহড়াকক্ষ। সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় ওঠার আগেই শোনা যাচ্ছিল গান। নারী কণ্ঠের ফারসি গান শুনে আগ্রহটা বেড়ে গেল। বাংলা নাট্যদলের কার্যালয় থেকে ফারসি গানের হেতু কী? নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, আরণ্যকের জনা তিরিশেক নবীন-প্রবীণ শিল্পী। কেউ ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মেঝেতে বসে আছেন, নানা দিকে দৃশ্যে ঢোকার অপেক্ষায় নানা দিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আরও কয়েকজন। পাণ্ডুলিপি হাতে সবুজ হাফশার্ট গায়ে এক ‘তরুণ’কে দেখা গেল সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। কখনো বসে সংলাপ ধরিয়ে দিচ্ছেন, কখনো নিজেই দৃশ্যে ঢুকছেন। আজ আমরা ‘কম্পানি’ নাটকের মহড়া দেখতে এসেছি, সেই নাটকের লেখক, নির্দেশক ও অভিনেতা তিনি, আরণ্যক কান্ডারি মামুনুর রশীদ। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি যিনি ৭৬ ছুঁয়েছেন। মঞ্চে বা মহড়াকক্ষে ঢুকলে বয়স যাঁর কাছে নিছক একটা সংখ্যা হয়ে যায়!
অভিনয়ে ব্যাঘাত ঘটবে না, সেটা নিশ্চিত করে মহড়ার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলি। একটার পর একটা দৃশ্য দেখে ধারণা পাই নাটকের গল্প। কখনো গান, সংলাপ, কখনো জাহাজের সাইরেন কিংবা আবার কখনো যুদ্ধের দামামা। ১৭৪৩, ১৭৪৪ সালে; ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টি থেকে শুরু। ভাগ্যান্বেষী পাড়ার মাস্তান রবার্ট ক্লাইভ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বখাটে, যুবক বয়সে মারকুটে। কোনো রকম স্কুল পাঠ শেষ করেছিলেন ক্লাইভ। এই ‘অপদার্থ’ ছেলের একটা গতি করতেই বদমেজাজি বাবা রিচার্ড ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, নিম্ন পদে ছেলের চাকরি হয়। ঘটনাচক্রে পাড়ার ছিঁচকে মাস্তান রবার্ট ক্লাইভ চাকরির সূত্রে ভারতগামী জাহাজের যাত্রী হয়। মাদ্রাজে জাহাজ ভেড়ে। গল্প পরিণত হয় ১৭৫৭ সালের জুনে এসে। মাঝে অপরিণত নেতৃত্ব, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধ, লুটসহ নানা প্রসঙ্গ আসে। এবং নাটকে শেষ চমক, একদম এই সময়ে এসে ঠেকে গল্পটা।
এটি আরণ্যকের ৬৬তম প্রযোজন। কথায় কথায় মামুনুর রশীদ জানান, আরণ্যক সব সময় বড় ক্যানভাস ও বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে নাটক করে। রাঢ়াঙ, সংক্রান্তি, জয়জয়ন্তীর মতো কম্পানিও একটি বড় ক্যানভাসের নাটক। তবে এটি ভিন্ন, পুরোপুরি ইতিহাস–আশ্রিত নাটক। মামুনুর রশীদ মনে করেন আমাদের ইতিহাসচর্চা কম। নাটকের ফর্মে ইতিহাসচর্চা খুব জরুরি। এসব তাগিদেই ইতিহাস–আশ্রয়ী এই নাটক। মামুনুর রশীদের ভাষ্য, ‘কূটনৈতিক চাল এবং নেতৃত্বে সিদ্ধহস্ত ক্লাইভের সঙ্গে বাংলার অপরিণত বয়সের নবাব সিরাজউদ্দৌলার সংঘাত এবং তার ফলে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। এ সময়ের মধ্যে যে ষড়যন্ত্র, উত্থান–পতন এগুলো দেখা যাবে নাটকে। তার ধারাবাহিকতায় উত্তর ঔপনিবেশিক যে পরিস্থিতি, তার যে মানসভূমি, তা-ও ধরার চেষ্টা করা করেছি এ নাটকে।’
‘কম্পানি’ নাটকটি আড়াই শ বছরের বেশি সময় আগেকার প্রেক্ষাপটে হলেও এটি এ সময়েও প্রাসঙ্গিক বলে জানালেন নির্দেশক। মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সেই থেকে শুরু করে যে হাতবদলগুলো হয় ক্ষমতার, তার পেছনেও ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি—সবকিছু যুক্ত থাকে। আমরা এটাই দেখাতে চাই যে এখনো সারা বিশ্বেই একটা কোম্পানির শাসন চলছে। এ কারণেই এর প্রাসঙ্গিকতা আমরা খোঁজার চেষ্টা করেছি। দখল ও লুটপাট এবং সর্বোপরি লুটকরা সম্পদের পাচারের সংস্কৃতি তো এখনো চলছে।’ এই ঈদে আপনার আনন্দের উৎস হোক মঞ্চনাটক’—স্লোগানে ঈদের দিন সন্ধ্যা ৭টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে হবে কম্পানির প্রথম প্রদর্শনী। টানা পাঁচ দিন একই সময় ও স্থানে দেখা যাবে নাটকটি।
গত কয়েক মাস আরণ্যক সদস্যরা ব্যস্ত সময় পার করেছেন কম্পানির মহড়া নিয়ে। এমনও হয়েছে, সকাল থেকে সারা দিন টানা মহড়া করেছেন। গতকাল শুক্রবারও সারা দিন মহড়া হয়েছে।প্রশংসা করতে হয় আরণ্যকের সদস্যদের। মহড়াকে তাঁরা মূল্য দেন, সিনিয়র–জুনিয়র প্রত্যেকেই হাজির হচ্ছেন নিয়মিত। সময় দিচ্ছেন। নাটকের প্রয়োজনে শিল্পীরা ফারসি, উর্দু ভাষা, বর্ণ শিখেছেন। সঠিক উচ্চারণ, সুরে ফারসি গান গাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ঈদ উৎসবে গান, চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েব সিরিজ—প্রায় সব ক্ষেত্রেই রমরমা থাকলেও ব্যতিক্রম ছিল মঞ্চ নাট্যাঙ্গন। সৈয়দ জামিল আহমেদ কয়েক বছর আগে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবার এগিয়ে এসেছে আরণ্যকের মতো বড় দলও। এ উদ্যোগের জন্য আরণ্যক এবং মামুনুর রশীদকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিঃশব্দেই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিই। শেষ দৃশ্যের সংলাপগুলো কানে আসে। কক্ষের মধ্যে একজন আসেন। যার নাম সেলিম, শিল্পপতি। সেলিম বলতে থাকেন, লর্ড রবার্ট ক্লাইভ আমাদের জাতীয় জীবনের এক অন্যতম বীর; এক মহান দিশারি! তিনি লুণ্ঠনকে একটি শিল্প শুধু না, ইংরেজি ডিকশনারিতে একটি নতুন শব্দ যোগ করে গেছেন ‘লুট’। লুট উর্দু শব্দ, তাঁর কারণেই লুট জায়গা পেয়েছে বাংলায়, ইংরেজিতে। আরেকটি হলো, তিনি সম্পদ লুট করে তা কীভাবে বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায়, তা শিখিয়েছেন!