Skip to content

তেলবাহী যান উল্টে আগুন ঠিকাদার কাজটি পান ‘জালিয়াতি’ করে 

    তেলবাহী যান উল্টে আগুন ঠিকাদার কাজটি পান ‘জালিয়াতি’ করে prothomasha.com

    সাভারে এই দুর্ঘটনায় চারজন পুড়ে মারা যান। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে ঠিকাদারের গাফিলতিকে। সাভারে জ্বালানি তেলবাহী যান (লরি) উল্টে চারজনের মৃত্যুর পেছনে যে ঠিকাদারের ‘গাফিলতি’ রয়েছে বলে অভিযোগ, সেই ঠিকাদার নির্মাণকাজটিও পেয়েছিলেন জালিয়াতি করে। নির্ধারিত সময়ে তাঁরা কাজ শেষও করেননি।  ঢাকার অদূরে সাভারের জোরপুল এলাকায় ২ এপ্রিল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তেলবাহী লরি উল্টে আগুন ধরে যায়। ওই আগুনে পাশের আরও চারটি যান পুড়ে যায়। এতে ১ শিশুসহ ১০ জন অগ্নিদগ্ধ হন। মারা যান ৪ জন। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের ভাষ্য, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোরপুলে ইউটার্ন (যানবাহন ঘোরানোর জায়গা) নির্মাণকাজের জন্য আনা ব্লক মহাসড়কে রাখা হয়েছিল। ছিল না কোনো সতর্কতামূলক নির্দেশনা। চাকার নিচে ব্লক পড়ে লরিটি উল্টে যায় বলে অভিযোগ আছে।

    সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, জোরপুল এলাকার ইউটার্নসহ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গাবতলী থেকে সাভারের মধ্যে চারটি ইউটার্ন নির্মাণের কাজ যৌথভাবে পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন, হাসান টেকনো বিল্ডার্স এবং রিলায়েন্স বিল্ডার্স। ২৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে কাজটি করার জন্য তাদের ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা গত বছরের জুনের মধ্যে। কিন্তু এখনো কাজ শেষ হয়নি। যদিও ২৩ কোটি টাকা বিল পেয়েছে তারা।

    এই চার ইউটার্ন নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে প্রায় ৬৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে। ২০১৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এর নাম ঢাকা (মিরপুর) উথুলি-পাটুরিয়া জাতীয় মহাসড়কের নবীনগর থেকে নয়ারহাট পর্যন্ত প্রশস্তকরণ এবং আমিনবাজার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত বাস বে (থামার জায়গা), সার্ভিস লেন (স্থানীয় যানবাহন চলার রাস্তা) নির্মাণ। গত বছরের জুনে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এখনো তা শেষ হয়নি।

    এই প্রকল্পে আলাদা দরপত্রে বিভিন্ন কাজ করা হচ্ছে। এর একটি হলো ইউ-টার্ন নির্মাণ। সওজের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সাভারে ইউটার্ন নির্মাণের কাজ পেতেও ভুয়া নথি (টার্নওভার বা বিগত পাঁচ বছরে যত টাকার কাজ করেছে) জমা দেওয়া হয়েছিল। এর আগেও আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনো বিল্ডার্স জাল নথি জমা দিয়ে কাজ পেয়েছে বলে সওজের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধও করা হয়। অর্থাৎ তারা এ সময় নতুন কোনো দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না।

     গত বছরের ১৪ অক্টোবর ‘সড়কের ৫১% কাজ পেয়েছেন ‘‘প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ’’ ৫ ঠিকাদার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বেশি কাজ পাওয়া শীর্ষ ঠিকাদারদের দুটি হলো আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনো বিল্ডার্স। পরে সওজর তদন্তে বেরিয়ে আসে, বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে প্রায় সবাই কাজ পেতে নথি জাল করেছিল। এর মধ্যে আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এখনো তদন্ত করছে সওজ।

    সওজ সূত্র জানায়, আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনো সাত-আট বছর ধরে সওজের একচেটিয়া কাজ পাওয়া শুরু করে। গত পাঁচ বছরের সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, সংখ্যা ৩ হাজার ১০০-এর মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ তারা পেয়েছে সওজের ঢাকা অঞ্চলে। অন্যদিকে হাসান টেকনো পাঁচ বছরে কাজ পেয়েছে পাঁচ শতাধিক।

    বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা করেও আবেদ মনসুর ও হাসান টেকনো বিল্ডার্সের কারও বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

    এদিকে সাভারে দুর্ঘটনা ও ঠিকাদারের ‘গাফিলতি’র বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনাসহ সার্বিক বিষয়ে তাঁরা অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করছেন। এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তিনি বলেন, যখন কাজ পায়, তখন তো নিষিদ্ধ ছিল না। এখন সবকিছু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

    নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই নির্মাণ

    সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নির্মাণকাজে অন্তত ৫ শতাংশ ব্যয় ধরা হয় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য। নিরাপদ যান চলাচল নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজন হলে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার নিয়ম। নির্মাণসামগ্রী কোনোভাবেই সড়কে রেখে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এসব নিয়মের কিছুই মানেনি সাভারে ইউটার্ন নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

    সওজের হিসাবে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে রাজধানী থেকে দৈনিক উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। স্বল্প দূরত্বের যানবাহন বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এর বাইরে অবৈধভাবে মহাসড়কে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত রিকশাও রয়েছে।

    সওজের প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও নতুন নতুন অঙ্গ যুক্ত করার ক্ষেত্রে ‘স্ট্যান্ডার্ড জিওমেট্রিক ডিজাইন’ অনুসরণ করার নিয়ম। মানে হলো, সড়কটির ভূমি ব্যবহার ও আশপাশের পরিস্থিতি অনুযায়ী নকশা করা এবং তা অনুসরণ করার কথা। কিন্তু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সম্প্রসারণ কাজে সেই মানদণ্ড মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

    সওজের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কাজ কতটা নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে করা হচ্ছে, তার নিরীক্ষা করানো উচিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দিয়ে।

    দুই পক্ষেরই ‘শাস্তি হওয়া উচিত’

    সওজ সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে ঢাকা থেকে সাভারের নবীনগর পর্যন্ত মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হয়। এখন এই মহাসড়ক সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) দ্রুতগতির টোল সড়ক হিসেবে উন্নীত করার আলোচনা চলছে। ওদিকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি এখন সম্প্রসারণের কাজ চলছে। পিপিপির ভিত্তির এটি দ্রুতগতির মহাসড়ক উন্নীত করলে এখনকার সম্প্রসারণ কাজ কাজে আসবে না বলে সওজের কর্মকর্তারা জানান।

    বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক তৈরির সময় এবং পরে প্রতিবার সম্প্রসারণ ও পরিবর্তনকালে নিরাপত্তা নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) করতে হয়। ফিনল্যান্ড সরকারের টাকায় সওজের জন্য একটি নিরীক্ষা নির্দেশিকা ২০০৫ সালে তৈরিও করা হয়; কিন্তু এটি মানা হচ্ছে না।

    ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যে ইউটার্নগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল উল্লেখ করে সামছুল হক আরও বলেন, ব্যস্ত সড়কে কাজ করার সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। এর জন্য টাকাও রাখা হয়। ইউটার্ন নির্মাণের প্রকল্পে নিরাপত্তার জন্য টাকা না ধরা থাকলে সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার শাস্তি হওয়া উচিত। আর টাকা ধরা থাকলে তা ব্যয় করে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় কর্মকর্তা ও ঠিকাদার-দুই পক্ষেরই শাস্তি হওয়া উচিত।