ভোলায় গ্যাস উৎপাদনযোগ্য কূপ আছে ৯টি। এর মধ্যে ৪টি থেকে বর্তমানে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে, তা–ও সক্ষমতার চেয়ে কম। তবু বিনা দরপত্রে নতুন করে আরও ৫টি কূপ খননের প্রস্তাব দিয়েছে গাজপ্রম। আগের চেয়ে এবার প্রতি কূপে বাড়তি খরচ হবে ৮৪ কোটি টাকা। জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কূপ খননের কাজটি বাপেক্স করলে খরচ আরও কমবে।
সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রতি কূপ খননে প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ ডলার করে নিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রম। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র বলছে, এবার তারা প্রতি কূপের জন্য চেয়েছিল ২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। প্রাথমিক সমঝোতার মাধ্যমে এটি কমিয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার দরে মোট ১২ কোটি ডলার করেছে কারিগরি কমিটি। তবে খরচ আরও কমাতে প্রস্তাবটি ফেরত পাঠিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এখন আবার গাজপ্রমের সঙ্গে সমঝোতা করছে কমিটি।
বর্তমানে প্রস্তাবিত দর অনুসারে প্রতি কূপে খরচ হবে ২৬৪ কোটি টাকা। শেষবার খরচ হয়েছিল ১৮০ কোটি টাকা। তার মানে প্রতি কূপে খরচ বাড়ছে ৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগের চেয়ে ২৮ লাখ মার্কিন ডলার বাড়তি ধরায় খরচ বাড়ছে ৩০ কোটি ৮০ লাখ (ডলার ১১০ টাকা ধরে) টাকা। আর গত তিন বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমনের কারণে খরচ বাড়ছে ৫৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। এতে পাঁচ কূপ মিলে আগের চেয়ে ৪২০ কোটি টাকা খরচ বাড়বে এবার।
গাজপ্রমের প্রস্তাবটি যাচাই করে প্রাথমিক সমঝোতা করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) গঠিত কারিগরি কমিটি। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) প্রতিনিধি ছিলেন। প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করতে জ্বালানিসচিবের নেতৃত্বাধীন প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির (পিপিসি) কাছে পাঠানো হয় গত মার্চের মাঝামাঝি। শেষ পর্যন্ত এ কমিটি দরপ্রস্তাবটি চূড়ান্ত করবে।
খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে কমিটির সদস্যরা বলছেন, বিশ্ববাজারে সব জিনিসের দামই বেড়েছে। এ ছাড়া দেশের সব কূপেই এমএস মেটালের পাইপ ব্যবহার করা হয়। এটি বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই এবার প্রথমবারের মতো কূপের ভেতরে উচ্চ মানের ক্রোমিয়াম মেটাল পাইপ ব্যবহার করা হবে। ভোলার গ্যাস ক্ষারীয় বলে এ পাইপ ব্যবহারের চিন্তা এসেছে। গ্যাস উৎপাদনে এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে, তাই খরচ বেড়েছে। তবে ক্রোমিয়াম পাইপের পরিবর্তে আগের মতো এমএস পাইপ ব্যবহার করা হলে প্রতি কূপে খরচ ২০ লাখ ডলার বা ২২ কোটি টাকা কমতে পারে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নূরুল আলম বলেন, এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দরপ্রস্তাব নিয়ে আরও সমঝোতা করতে পুনরায় কারিগরি কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই দর কমাবে গাজপ্রম।
খরচ বাড়ছে প্রতিবার
প্রতিবারই খরচ বাড়িয়েছে গাজপ্রম। ২০১২ সালে প্রথম কূপ খননের কাজ পায় গাজপ্রম। ওই সময় প্রতি কূপে খরচ হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। ২০১৭ সালেও তারা প্রতি কূপে নিয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা পর্যন্ত। পরের দুবার আরও বেড়েছে। এ পর্যন্ত মোট ২০টি কূপ খননের কাজ করেছে গাজপ্রম। এর মধ্যে ভোলায় ৭টি কূপ খনন করেছে তারা। সব কূপ খননের কাজই পেয়েছে দরপত্র ছাড়া; বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাপেক্স নিজেই ৮০ থেকে ৮৫ কোটি টাকায় কূপ খনন করতে পারে। এতে অতিরিক্ত অর্থ অপচয় প্রতিরোধ করা যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া ভোলার গ্যাস পুরোপুরি ব্যবহারের কোনো উপায় তৈরি হয়নি। তাই তাড়াহুড়ো না করে বরং বাপেক্সের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কূপের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কূপ খননে জোর দিলেও আসল কাজে হাত দেওয়া হচ্ছে না। ভোলার গ্যাস ব্যবহার করার জন্য সেখানে শিল্পকারখানা বাড়ানো যায়নি। আবার ভোলার বাইরে গ্যাস আনার পাইপলাইনটি করা যায়নি গত তিন দশকেও। বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব বলেন, ভোলার গ্যাস বাইরে আনার পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সরকারের। এটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করতে হলে দিনে ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা থাকতে হবে। বর্তমানে ৯টি কূপ থেকে ১৮ কোটি ঘনফুট উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। নতুন পাঁচটি কূপ হলে আরও ১০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন সক্ষমতা বাড়বে। দর প্রস্তাব নিয়ে এখনো সমঝোতা চলছে।
গ্যাস উৎপাদন সক্ষমতার কম
ভোলায় এ পর্যন্ত তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাপেক্স। এর মধ্যে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে দুটি, ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রে দুটি কূপ খনন করা হবে। এ চারটি মূলত গ্যাস উৎপাদন শুরু করার জন্য উন্নয়ন কূপ করা হবে। এর বাইরে এ দুটি গ্যাসক্ষেত্রের মাঝামাঝি একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। গাজপ্রমের সঙ্গে শিগগিরই চুক্তি হলে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই পাঁচটি কূপ খননের কাজ শেষ করবে তারা।
পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুত গ্যাস উৎপাদন করা দরকার। তিন বছরে ৪৬টি কূপ খননের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাপেক্স একা করলে ১০ বছর পার হয়ে যাবে। তাই বাপেক্সের সক্ষমতা শতভাগ ব্যবহার করার পাশাপাশি ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কূপ খননের খরচে যুক্ত করা হয় না। এটি ধরা হলে কূপ খননে প্রকৃত খরচ আরও বেশি হবে। ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, ভোলার গ্যাস বাইরে আনতে কার্যকর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে একের পর এক উৎপাদন কূপ খনন করাটা যৌক্তিক নয়। এর চেয়ে গ্যাস বাইরে আনতে আগে পাইপলাইন করাটা জরুরি ছিল। এ ছাড়া যেখানে বাপেক্স নিজেই কম খরচে কূপ খনন করতে পারে, সেটা গাজপ্রমকে দিয়ে চড়া খরচে করানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।