অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর থেকে প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার মুখে শুনে আসছি—প্রবাসীদের কল্যাণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা, বিমানবন্দরে প্রবাসীদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়ার কথা। কথা হচ্ছে, দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অপরিসীম অবদানের কথা সব সরকারই স্বীকার করে। অতীতের সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা সব অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা প্রবাসীদের অর্থনৈতিক অবদানের কথায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তাঁরা যে প্রবাসীদের জন্য নানা উদ্যোগ নেননি, তা নয়। তবে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক, মূলত প্রবাসীদের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। প্রবাসীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট নবায়নে নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া। বিশেষ করে সময়মতো পাসপোর্ট না পাওয়া। মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হওয়ার কত নিউজ আমরা খবরে দেখি, পড়ি। অথচ এ সমস্যা কীভাবে লাগব করা যায়, সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সরকার বা দূতাবাস যথার্থ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। ভাবলে তো এ সমস্যা চিরকালের সমস্যা হয়ে রয়ে যেত না।
এই ধরুন, মালয়েশিয়ার কথাই বলি। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ প্রবাসীর বসবাস। রেমিট্যান্সের জন্য মালয়েশিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সংখ্যা বিবেচনায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরই মালয়েশিয়ার অবস্থান হয়তো। সঠিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরাতের চেয়ে বেশি প্রবাসী মালয়েশিয়ায় হতে পারে! মালয়েশিয়ায় এই বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর প্রধান সমস্যা নানা সময়ে পাসপোর্ট পেতে বেগ পাওয়া। পাসপোর্ট নবায়নে সব সময় সমস্যা হয় বা সব প্রবাসী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, ব্যাপারটা এমনও নয়। কিন্তু সমস্যার সম্মুখীন হওয়া প্রবাসীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ ২১ বছরের প্রবাসজীবনে এ সমস্যা অনেকবার দেখেছি। প্রবাসীদের জন্য পাসপোর্ট হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন প্রবাসী যত টাকাই আয় করুক, কাজ থাকুক বা না থাকুক, পাসপোর্ট থাকা চাই। ভিসা বা পারমিট থাকা চাই। ভিসা বা পারমিটের জন্য পাসপোর্ট থাকাটা অপরিহার্য। পাসপোর্টের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রের ১ নম্বর সেবা হচ্ছে পাসপোর্ট। বাঁচার জন্য মানুষের যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পাঁচটি মৌলিক চাহিদার কথা সেই ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি, তেমনি প্রবাসে এসে বুঝেছি প্রবাসীদের প্রাপ্য মৌলিক সেবা হচ্ছে পাসপোর্ট। এ জন্য প্রত্যেক প্রবাসীর পাসপোর্ট পেতে সহজলভ্য করা উচিত ছিল রাষ্ট্রের বা সরকারের। পাসপোর্টের পাশাপাশি ট্রাভেল পাস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ। কোনো প্রবাসীই যেন পাসপোর্ট পেতে অযথা সমস্যার সম্মুখীন না হন, এমন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। অথচ সব সরকারই এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে বলা যাবে না। এ কথা বলছি এই কারণে যে মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা অফিসে সেবা নিতে আসা প্রবাসীদের হয়তো মৃদু আঘাত করা। এই আঘাত যাঁরা করছেন, তাঁরা পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী। অনেক প্রবাসী গাদাগাদি করে দাঁড়িয়েছেন, ঠেলাঠেলিও হচ্ছে। মালয়েশিয়রা সাধারণত ধাক্কাধাক্কি ও ঠেলাঠেলি পছন্দ করে না। সঠিক না জেনে বলছি, হয়তো ধাক্কাধাক্কির কারণে মালয়েশিয়রা নিরাপত্তাকর্মীরা এমনটা করে থাকতে পারেন। পেছনে খালি জায়গা পড়ে থাকলেও বাংলাদেশিরা স্বভাবতই কোথাও লাইনে দাঁড়ালে গাদাগাদি করে দাঁড়ায়, ঠেলাঠেলি করে দাঁড়ায়। এখানে অবশ্যই পেছনে খালি জায়গা ছিল কি না, আমার জানা নেই।
আমার কথা হচ্ছে, আমাদের লোক কেমন আমরা জানি, আমাদের প্রবাসীদের আমরা চিনি ও জানি। তারা আমাদেরই ভাই। তাদের সেবা দিতে হলে কীভাবে দেব, কখনো সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে গেলে তখন কী করব, জাতীয়ভাবে দেশে পাসপোর্ট প্রিন্ট করতে বিলম্ব হলে কী করব, প্রবাসীদের আগাম কী জবাব দেব, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে বিষয়টা কীভাবে জানালে আমাদের প্রবাসীদের প্রতি পাসপোর্টের ব্যাপারে নমনীয় হবে—এগুলো আমাদের (দূতাবাসের বা পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা কর্তাদের) আগে থেকে তৈরি থাকার কথা। বেশ কয়েক বছর আগেও দেখেছি, দূতাবাসে পাসপোর্ট ও ট্রাভেল পাস নিতে আসা প্রবাসীরা নানাভাবে হেনস্তা হয়েছেন।
আমি এর আগেও লিখেছিলাম, স্বভাবত মানুষ যে দেশে থাকেন, সে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কেউ ভালোভাবে, কেউবা একটু কম। প্রবাসীরা নানা সেবা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যান। সেখানে তাঁরা ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কির সম্মুখীন হন না। কাজ হোক না হোক, তবে কোনো ধরনের হেনস্তার স্বীকার হন না। প্রয়োজনীয় সঠিক পরামর্শ কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কাছ থেকে পান। অথচ স্বদেশের দূতাবাসে গেলে সম্মুখীন হতে হয় নানা হয়রানির। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কথা হচ্ছে, নিয়মকানুন সব প্রবাসীর জানতে হবে। তাদের সময় নেই নিয়ম বোঝানোর ও বুঝিয়ে দেওয়ার। তারা হিসাব করে বছরে কত হাজার পাসপোর্ট বিতরণ করেছে, কত হাজার ট্রাভেল পাস ইস্যু করেছে, কত কাগজপত্র সত্যায়িত করেছে। তারা অনেক অনেক কাজ করেছে, তাদের রেকর্ড আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তাদের তারা দেখাতে পারে অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু তারা অনুভব করতে পারেন না ওই সেবাগুলো নিতে গিয়ে প্রবাসীরা তাদের কাছে (দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাছে) কতটা অসহায় ছিলেন! কতটা নিরীহ বোধ করেছিলেন সেবা নিতে আসা অধিকাংশ প্রবাসী। হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য দালাল ধরেছেন। খরচ করেছেন বাড়তি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা সেবাটি কীভাবে পেয়েছেন, সেই রেকর্ড দূতাবাসের খাতায় নেই। দূতাবাসের রেকর্ডে আছে কেবল কাজ আর কাজ।
প্রবাসীদের শুধু পাসপোর্ট ইস্যু, ট্রাভেল পাস ইস্যু ও কাগজপত্র সত্যায়িত করে দিলে হয় না। এই সেবাগুলো তাঁরা কতটা সহজভাবে পেয়েছেন, সেটাই বড় কথা। সেবাগুলো সহজভাবে প্রাপ্যটা তাঁদের মৌলিক অধিকার, এটাই কর্মকর্তারা বোঝেন না। তাঁরা বোঝেন না প্রবাসীদের সেবা দেওয়া মানে শুধু পাসপোর্ট-ডকুমেন্টসে স্বাক্ষর করা নয়, তাঁদের আবেদনপত্র সঠিকভাবে করানোয় সহযোগিতা করাও একটি প্রধান কাজ। তাঁদের দালালের কাছে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে দূতাবাসের কর্মচারীরা সহযোগিতা করাটাই প্রবাসীদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা যথাযথ হয়।
প্রয়োজনে দূতাবাসের কনস্যুলেট অফিস বাড়ান। প্রবাসীদের সেবা দেওয়ার জন্য কিছু খরচ বাড়ান। আমরা প্রবাসী বিদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, বিদেশে স্বদেশের দূতাবাসে যেতে (কাজে) ততটা বিপদগ্রস্ত বোধ করি! অধিকাংশ প্রবাসীর কাছে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাওয়া (কাজে) মানে বিশাল অস্বস্তিকর ব্যাপার।
প্রবাসীরা যেদিন বিদেশে বাংলাদেশ হাইকমিশন বা দূতাবাসে যাওয়ার জন্য অস্বস্তিবোধ করবেন না, সেদিন মনে হবে রাষ্ট্র প্রবাসীদের যথাযথ সেবা দিতে পারছে। কীভাবে কী করলে প্রবাসীরা সহজভাবে সেবা পাবেন, সেটার কর্মপন্থা তৈরি করুন, কর্মপন্থা কী রকম হবে, সেটা বের করার জন্য দেশের নাগরিকদের করের টাকায় হাজারো মেধাবীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা আন্তরিকভাবে চিন্তা করলেই সব সম্ভব। সঙ্গে সরকারে নেতৃত্ব দেওয়া বিজ্ঞ ব্যক্তিরা তো আছেনই। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ প্রবাসীদেরও নানাভাবে কাজে লাগাতে পারেন।
প্রবাসীদের অন্যান্য সেবা নিয়ে পরবর্তী সময়ে লিখব আশা রাখি। প্রবাসীদের ও দেশের সব মানুষের নাগরিক সেবাপ্রাপ্তি সহজলভ্য হোক।
লেখক: মালয়েশিয়াপ্রবাসী