বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে এক জরিপে চিহ্নিত করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিচালিত এই জরিপে ব্যবসায়ীদের মতামতে উঠে এসেছে মোট ১৭টি বিষয়। তারা বলছেন, দেশে ব্যবসা পরিচালনায় ঘুষ লেনদেন আরো বেড়েছে। ৫৭ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী মনে করেন, কর সংক্রান্ত সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়। আগের বছর এ অভিযোগ ছিল ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবসায়ীর।
এক্সিকিউটিভ ওপেনিয়ন সার্ভে (ইওএস) প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি পরিচালিত হয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সহায়তায়। জরিপে তথ্য সংগ্রহ করা হয় গত এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে। এতে সেবা খাত, শিল্প ও কৃষি খাতের দেশি- বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা তাদের মতামত দেন। এতে দুর্নীতি ছাড়াও এতে অদক্ষ সরকারি আমলাতন্ত্র, ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর আছে মূল্যস্ফীতি ও মূলধন পাওয়ার সীমিত সুযোগ।
রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এক সংলাপে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলেন, বিগত সরকারের আমলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে সীমিত অগ্রগতি দেখা গেছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম কয়েকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি ছিল।
তিনি বলেন, আগামী দুই বছরের জন্য সামাজিক ঝুঁকি বিবেচনায় তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে রয়েছে- বেকারত্ব, জ্বালানি ঘাটতি, অসংক্রাম রোগের প্রাদুর্ভাব অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা এবং সামজিক অবক্ষয়।
দেশে ব্যবসার পরিবেশ সংস্কার নিয়ে এ সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলী শামীম এহসান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেলসহ আরো অনেকে বক্তব্য দেন।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্যবসা সহজীকরণে ১৭টি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে-দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, নীতির অস্থিতিশীলতা, দুর্বল শ্রমশক্তি, শিক্ষিত শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা, উচ্চ কর হার, কর জটিলতা, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরাধ, উদ্ভাবনের জন্য অপর্যাপ্ত সক্ষমতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঝুঁকিপূর্ণ জনস্বাস্থ্য এবং শ্রমনীতির সীমাবদ্ধতা।
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, আমাদের সিস্টেমের পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক এবং জনগণের ঐকমত্যে শক্তি দরকার। না হলে জনসাধারণের কাছে ভুল মেসেজ যাবে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, বিগত সরকারের সময় নেওয়া ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল কোনোভাবেই একসঙ্গে চালানো সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই এটা কমিয়ে আনবো। কমিয়ে ১০টি বা তারও কম নিয়ে কাজ করা যায় কি না; সে বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সবাই সংস্কার সংস্কার করছে। কিন্তু কে এটা করবে? অন্তর্বর্তী সরকার? এটা চলমান একটি প্রসেস, স্বল্প সময়ে একটি রাষ্ট্রের পুরো সংস্কার হতে পারে না। আমি ৮০-র দশক থেকে দেখে আসছি, আজকের এই আলোচিত সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বৈরাচারী আচরণ বাণিজ্য ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটা দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতি থেকে আমরা এটা আশা করতে পারি। এটা শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। সবকিছুর আগে রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে। না হলে ৪০ বছরে যা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
সিপিডির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল। পটপরিবর্তনের পরও এর প্রভাব অব্যাহত আছে।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে দেশের বিশ্বাসযোগ্য থাকতে হবে। আমাদের অবশ্যই কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা যেন মধ্যম আয়ের ফাঁদে না পড়ে যাই সেদিকে লক্ষ্য রেখে রিফর্ম করতে হবে। এটার জন্য কোরিয়া মডেল ফলো করা যেতে পারে।