১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ কারোর দলের সম্পত্তি নয়, তেমনি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণবিপ্লব কারোর কোনো পক্ষের বা দলের পৈত্রিক ভিটামাটি নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রির জন্য ধিক্কৃত হয়েছে আওয়ামী লীগ। এই চেতনায় দলটিকে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জামায়াত যৌথভাবে জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লব নিজেদের মনে করে যে সমন্বয়হীনতা, বিশৃঙ্খলা সৃস্টি করছে তাতে বিপ্লব হাতছাড়ার উপক্রম হয়েছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সম্পৃক্ত নয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের সরকারে সম্পৃক্ততা করা হয়েছে। জামায়াত যেভাবে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে নিজেদের ঘরে তোলবার প্রাণপন চেষ্টা করেছে তা নিন্দনীয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাজে অন্দরমহলে জামায়াত নানাভাবে বাঁধাগ্রস্থ করে আসছে। প্রকারান্তে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, এই সরকার ও ছাত্র আন্দোলন তাদের। সরকরের ভীতরে জামায়াতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসিকতা এই সরকরকে সমন্বয়হীন করে তুলেছে। বিশৃঙ্খলার ছাপ ছড়িয়ে পড়ছে। জামায়াতের সংকীর্ণ মানসিকতা বৃহৎ পরিসরে প্রকাশ পাওয়ায় এই সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। নির্বাচন বিলম্বিত করবার নানা ষড়যন্ত্র ফাঁসও হয়েছে। যদিও নির্বাচন না করে বর্তমান সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় রাখবার কয়েকটি পদক্ষেপ ইতোমধ্যে রুঁখে দেওয়া হয়েছে।
ভোটের মাঠে দুর্বল জামায়াত কৌশলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে প্রচুর রিক্রুট করেছে। কৌশলগত রাজনীতিতে হয়তো দলটি অনেক এগিয়ে। তার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দৃশ্যমান সুবিধা না করতে পেরে বিগত ১৫টি বছর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে প্রচুর জামায়াত-শিবির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। এখন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ। শিবিরের অনুপ্রবেশকারীরা এখন সাধারণ শিক্ষার্থী হয়ে গেছেন। ছাত্র সংসদ রাজনীতির নামে নিজেদের প্যানেল প্রস্তুতি শুরু করেছে। পরিচয় লুকিয়ে যারা এতোদিন ফ্যাসিবাদ লালন করেছিল তারা কি ফ্যাসিবাদ না? হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম তারা তো ছাত্রলীগের পদধারী ছিলেন, তারা কি ছাত্রলীগের ব্যানারে অপরাধ করেনি? সারজিস নিজেই তো ফ্যাসিস্ট হাসিনার সঙ্গে দেখা করে গর্বের সঙ্গে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে রসায়ন বেশ চমৎকার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবি করে বাংলাদেশের টেন্ডার নেয় আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধীতা করে জামায়াত। এজন্য দলটিকে স্বাধীনতা বিরোধী বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই দুটি দলের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে বিভক্ত করে দেয় জনগনকেও। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধ বিতর্কিত করতে কার্পণ্যবোধ করেনি আওয়ামী লীগ ও জামায়াত।
আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনীতি, অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত। এই দুটি দল দেশের জন্য বা রাষ্ট্রের জন্য বেশ ক্ষতিকর। রাজনীতি বিবরণ, নষ্টামি সবকিছুতেই তাদের অবদান অনস্বীকার্য। এই যে নিষিদ্ধ রাজনীতির খেলা, টানাহেঁচড়া, প্যান খোলা, রগকাটা, দিগম্বর করানো সবই কিছুরই উদ্ভাবক বলা হয় আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতকে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আর সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নষ্ট স্লোগানে বিগত ৫৩ বছর বাংলাদেশের জনগণকে পেছনে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উন্নয়ন আর অগ্রগতির নামে ভণ্ডামী শেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জনগণের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার, অত্যাচার করা হয়েছে। চেতনার ব্যবহার করে মানুষকে জিম্মি করে লুটপাট করা হয়েছে। মেধাবীদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। গুম, খুন, ধর্ষণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ধর্মের নামে কুটনামি, নষ্টামি, টুপি পরে ঈমান নষ্ট করানো হয়েছে। ইসলামের নামে অপরাধ করা হয়েছে। ইসলামের নাম ব্যবহার করে এমন কোনো খারাপ কাজ নেই, যে তা করা হয়নি। রাজনীতে ধর্মের অপব্যবহারের কারণে ধর্মকে মানুষের কাছে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। একইভাবে অসাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িকতার নামে বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার বিপন্ন হয়েছে।
আবার বিভক্তির পাশাপাশি এই দুটি রাজনৈতিক দলের সেতুবন্ধনও দারুন। ঘোষণা দিয়ে বলা যেতে পারে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ শাসনের মূল কারিগর আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত। ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলেও শুধু মাত্র আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশগ্রহণ করে। এরশাদের ক্ষমতায় যাওয়ার বৈধ লাইলেন্স দেয় আওয়ামী লীগ ও জামায়াত। এই দুটি দলের সহযোগিতার কারণে দেশের প্রথম ফ্যাসিবাদ শাসক হয়ে উঠে এরশাদ। আবার দেশের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আবিস্কারক দাবিদার জামায়াত। সেই জামায়াতি তত্ত্বে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকরের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলন শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াত।
আওয়ামী লীগ-জামায়াত যৌথভাবে দিনের পর দিন আন্দোলন করে দেশ অচল করে দিয়েছিল। জামায়াতকে সিঁড়ি বানিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এসেই ত্রাসের শাসন শুরু করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ১৩৩টি সংসদীয় আসনের সীমানা কর্তন করে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আয়োজিত নির্বাচনে জয়লাভ করে বেপরোয়া হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগকে পুর্নজন্ম দেওয়া জামায়াতকে ধবংসের মিশনে নেমে দেশটার বারোটা বাজিয়ে তোলে।
আওয়ামী লীগ-জামায়াতের এই নোংরামী রাজনীত বর্তমান বাংলাদেশে অকার্যকর। আগামীর বাংলাদেশে এই দুটি দলের দূষিত রাজনীতি সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে ঘৃণিত হয়েছে। বিগত ১৫ বছর কৌশলে অনুপ্রবেশ করিয়ে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত দেশ শাসন করে। তাদের যৌথ শাসনামলে আমরা গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা হারিয়েছি।
যারা আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে ভালোভাবে জানে তারা কখনোই এই দুটি দলের রাজনীতি করতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লব কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। এই দুটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের তৈরির মূল কারিগর ছাত্র-জনতা। পেছনে ছিলেন নেপথ্যে মুক্তিকামী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
ছাত্র-জনতার মুক্তিযুদ্ধ এবং গণবিপ্লব নিয়ে ফাজলামো করলে পরিণতি হবে নিষ্ঠুর। আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতকে আরও পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে জনগণের সামনে আসতে হবে। পুরাতন ধ্যান-ধারণা নিয়ে এই দুটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতি বর্জনীয় প্রমাণিত। অবাক ব্যাপার হলো- আমাদের দেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশের অনুপ্রবেশে বাধ্য করেছে এই দুটি দল। একটি দল মনে প্রাণে ভারতীয় আরেকটি দল মনে প্রাণে পাকিস্তানী ধ্যার-ধারণায় বিশ্বাসী। আমাদের রাজনীতিতে কেন ভারত বা পাকিস্তানের নাম আসবে? তারা আমাদের দেশ নিয়ে ভাবার কে? আমরা কেন পেছনে ফিরে যাব? এই পেছনে ফিরে যাওয়ার রাজনীতি আর চলবে না। মানসিক ও দৃশ্যমান রাজনীতির সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। ব্যক্তির জন্মদিন, মৃত্যদিন মার্কা রাজনীতি চিরতরে বিনাশ করতে হবে। কার্যত নির্বাচনি ব্যবস্থায় ফিরে আসতে হবে। যেকোনো মূল্যে জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। জনগনকে ভোটদানের সুযোগ দিয়ে পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটি যতদ্রুত করা যাবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল। দেশকে নিরাপদ করতে নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালিত হতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মকে রাজনীতিতে আনবার কারণে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। জড়িয়ে পড়ছি দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতে। অবিলম্বে আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মের ব্যবহার আইন করে বন্ধ করতে হবে। এটি করতে পারলে বাংলাদেশের সকল সমস্যা নিমিষেই সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের অগ্রগতি থামাতে পারবে না কেউ। আমরা বাংলাদেশি, আমরা গর্বিত বাংলাদেশি। এটাই আমাদের পরিচয়, এটাই আমাদের ঠিকানা।