রাজধানীতে আসতে শুরু করেছে কোরবানির গরু। অনলাইন ও ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা খামারে গরু বিক্রিও হচ্ছে।কয়েক দিনের মধ্যে জমে উঠবে গরুর হাট। গরুর হাটে পারদর্শিতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে গরু কেনার মানুষের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। ফলে ভালো পশু কিনতে গিয়ে অনেকেই গরুর ব্যাপারীদের খপ্পরে পড়ে বাড়তি টাকা গোনেন, কেউ আবার অসাধু বিক্রেতার ফাঁদে পড়ে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা পশু কিনেন। আবার অনেকে নাদুস-নুদুস মোটা গরু কেনার ফাঁদে পড়েন।
অনেকে একটু কম দামে বিষাক্ত রাসায়নিকে মোটাতাজা করা গরু কিনে প্রতারণার শিকার হন। অনেক সময় কোরবানির জন্য কেনা এসব পশু ঈদের আগেই মারা যায়। তাই কোরবানির জন্য সুস্থ ভালো গরু কেনার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।পশু চিকিৎসক, মাংস ব্যবসায়ী, কৃষক ও খামারিরা গরুর কিছু লক্ষণ পরখ করে সুস্থ গরু কেনার টিপস দিয়েছেন। তাদের মতে, কোরবানির হাটে প্রথমে গরুর আচরণের দিকে খেলায় করতে হবে। দেখতে আকর্ষণীয় ও চকচকে হলেই যে গরুটি ভালো হবে- তা মনে করার কারণ নেই। যদিও চোখের সৌন্দর্যেই গরু কিনে থাকেন অনেকে। কালো অথবা লাল রঙের কাঁড়া শিংয়ের তাগড়া মোটা গরুর প্রথম দর্শনে পটে যান বেশির ভাগ ক্রেতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই থেকে চার দাঁতের গরুর মাংস সুস্বাদু হয়ে থাকে। সাধারণত গুঁতো দিতে উদ্ধত্য, ক্ষেপাটে ও তিড়িং বিড়িং করা গরু সুস্থ হয়ে থাকে।পবিত্র কোরবানির ঈদে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা সাধ্যমতো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সুস্থ ও ভালো পশু কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করেন। পশুর হাটে ক্রেতারা দেশি গরু খুঁজতে খুঁজতে গলদগর্ম হয়ে থাকেন। কারণ দেশি গরুর মাংসের স্বাদ বিদেশি গরুর চেয়ে ভালো। আবার গরুর হাটে নাদুস-নুদুস রোগাক্রান্ত বিদেশি গরুর ভিড়ে দেশি ভালো গরু চিনতে অনেকেই হিমশিম খেতে হয়। কেউ কেউ বিষাক্ত রাসায়নিক ও ইনজেকশন দিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে মোটাতাজা করা বিদেশী ক্রস গরু কিনে প্রতারিত হন।
মিরপুর ডিওএইচএস এর আট নম্বর ব্লকের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা আফসার উদ্দিন। গত বছর কোরবানির ঈদের তিন দিন আগে দুই ছেলেকে নিয়ে গরু কিনতে যান মিরপুরের ইস্টার্ণ হাউজিং হাটে। ছোট ছেলে সাফওয়ানের পছন্দে এক লাখ ১০ হাজার টাকায় ক্যাড়া শিং ও লাল রঙয়ের একটি নাদুস-নুদুস বড় গরু কিনেন। গরুটি বেশ শান্ত। বাচ্চারা গরুর কাছে গিয়ে ধরলেও গরুটি নাড়াচাড়া করে না। সুন্দর তেলতেলে ঢাউস আকারের গরু দেখে প্রতিবেশীরা আফসার সাহের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলেন, একদিন আগেই এমন সাইজের গরু দুই লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ঈদের একদিন আগে সকালে হঠাৎ আফসার সাহেবের গরুটি মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা বের হওয়া শুরু হয়। এ সময় আফসার সাহেব বাসার কোনো কাজে বাইরে ছিলেন। বাসার কাজের লোক লোকমান আফসার সাহেবকে ফোন করেন। সাহেব হন্ন্যদন্য হয়ে বাসায় আসেন। এসে দেখেন গরুর মুখ দিয়ে ফেনা ঝড়ছে। আর পাতলা পায়খানা হওয়ায় গরুর পুরো শরীর মেখে গেছে। চারপাশে বিদঘুটে দুর্গন্ধ। এক রাতেই গরু শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। আফসার সাহেব কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। পরিচিতরা গরুকে পশু চিকিৎসক দেখানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু কোথায় পশু হাসপাতাল আর কোথায় বা পশু ডাক্তার পাওয়া যায় জানা নেই তার। পশু চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়ার আগেই মারা যায় গরুটি। আফসার সাহেবের মাথায় হাত পড়ে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুকে নিদির্ষ্ট পরিমাণ খাবার দিয়ে মোটা-তাজা করলে তার মাংস ক্ষতির কারণ হয় না। অথচ কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠে একশ্রেণীর খামারি। ঈদের কিছুদিন আগে রোগাক্রান্ত ও শীর্ণকায় গরু অল্প টাকায় কিনে বিষাক্ত হরমোন, ইনজেকশন ও রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করে গরুকে দুই-তিন মাসে মোটাতাজা করে। বেশি মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত বিষাক্ত ডোজ ব্যবহার করে ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে গরুগুলো কোরবানির হাটে তোলে। এসব গরুর মাংস খেলে লিভার, কিডনি, হƒদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্তসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অভিজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ গরুর মধ্যে থাকবে অফুরন্ত চাঞ্চল্য। চটপটে ও আশপাশ খেয়াল রাখবে। কান খাড়া থাকবে, ভারি আওয়াজে এদিক ওদিক দৌড়াতে চাইবে। খ্যাপাটে স্বভাবের এসব গরু যাকে সামনে পাবে থাকেই গুঁতো দিতে উদ্ধত্য হবে। তবে শরীরে পানি জমার কারণে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবে। নড়াচড়া কম করবে। সুবোধ বালকের মতো-হেলে দুলে ধীরে চলবে। রোদে থাকতে চাইবে না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের এনিম্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ড. আহসান হোসেন বলেন, স্বাভাবিকভাবেই গরুর গায়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে মাংস একটু দেবে যায়। সুস্থ গরুর ক্ষেত্রে এই চাপ ছেড়ে দিলেই মাংস স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর গায়ে আঙুলের চাপ দিলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বেশি সময় নেয়। পাশাপাশি ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর মাংসে পানি জমার কারণে মাংস নরম হয়ে যায়। সুস্থ গরুর রানের মাংস থাকবে শক্ত। আর ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর ক্ষেত্রে তা হয় নরম। এসব লক্ষণ দেখেও কোরবানির পশুর হাটে ভালো গরু পরখ করে নেওয়া যায়।
গরুর খামারি গাজীপুরের শ্রীপুরের আমেরিকা প্রবাসী আকরাম হোসেন জানান. গরুর পাঁজরের হাড়ে যে তিন কোণা গর্ত রয়েছে দুপাশে যাকে ফ্লায়েন্ট জয়েন্ট বলে তাতে কোনা রয়েছে কিনা সেটি খেয়াল রাখতে হবে। যেসব গরুতে স্টেরয়েড দেয়া থাকে সেসব গরুর পাঁজরের স্থান ফোলা থাকে। সেখানেও মাংস থাকে। সুস্থ গরু চিনতে হলে পাঁজরের হাড়েও খেয়াল করতে হবে। সুস্থ গরুর পাঁজরের হাড়ে উঁচু নিচু থাকবে। এদিক-সেদিক দৃষ্টি ঘুরাবে, নড়াচড়া করবে বেশি। তিনি আরও বলেন, কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর বুক অস্বাভাবিক ফোলা থাকবে। সুস্থ গরুর তুলনায় অসুস্থ গরু প্রশ্রাব করে বেশি। প্রশাবের রং লাল হয় অনেক সময়। আর গরুর বুকের নিচে অনেক বেশি পানি থাকে এবং নিচ দিকে ঝুলে থাকে। সুস্থ গরুর বুকে পানি থাকে কম প্রশ্রাবও করে কম। গোবর হয় স্বাভাবিক। কৃত্রিম উপায়ে ইনজেকশন দিয়ে মোটাতাজা করা গরুর আরেকটি লক্ষণ হল মুখে অতিরিক্ত লালা বা ফেনা থাকা।
কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতা সোহেল রানা বলেন, মোটা গরুতে চর্বি অনেক বেশি হয়। দেশি গরু কিনতে চেষ্টা করবেন। শিং ভাঙ্গা আছে কিনা, লেজ, মুখ ও দাঁত এসব কিছুই ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখবেন। পশু কেনার আগে এর শরীরের কোথাও ক্ষত চিহ্ন আছে কিনা তা ভালোভাবে দেখে নিবেন। গাভী না কেনাই ভালো। তারপরও কেনার আগে নিশ্চিত হন গাভীটি গর্ভবতী কিনা। সুস্থ গরু, মহিষ, ছাগল খাবার গ্রহণে আগ্রহ থাকবে। গরু, মহিষ, ছাগল ভেড়া এরা খাওয়ার পর পুনরায় খাবারগুলো মুখে নিয়ে আসে। অর্থাৎ জাবর কাটে। সুতরাং জাবর কাটছে এমন অবস্থা সুস্থ প্রাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্র্য। জাবর কাটা দেখে নিশ্চিত হতে পারেন পশুটির পরিপাকশক্তি ঠিক আছে।
পশু চিকিৎসক ড. আফসার আলী বলেন, কেনার আগে পশুটিকে হাঁটিয়ে নেবেন। এতে পায়ে সমস্যা থাকলে ধরা পড়বে। চঞ্চল, চটপটেও গুঁতো দিতে উদ্ধত্য খ্যাপাটে দেখলে বুঝবেন-গরুটি সুস্থ। ওষুধ খাওয়নো গরুর শরীরের অঙ্গগুলো নষ্ট হতে শুরু করায় এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়। মনে হবে হাঁপাচ্ছে। গরুর শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে বুঝবেন গরুটি অসুস্থ। সুস্থ গরুর নাকের ওপরের অংশটা ভেজা বা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা থাকবে। অন্য দিকে অসুস্থ গরুর নাক থাকবে শুকনা। এ ছাড়া চামড়া ওঠা, শিং ভাঙা, লেজ কাটা, জিহ্বা, ক্ষুর, মুখ, গোড়ালি ক্ষত আছে কি না তা ভালো করে দেখে নিতে হবে। ক্ষত আছে এমন গরু কোরবানি হয় না বলে সমাজে প্রচলিত আছে।