আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফৌজদারি মামলায় সাজার মুখোমুখি হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে ৭৭ বছরের ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে আমেরিকায় শুরু হয়েছে জল্পনা। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করলে ট্রাম্প নিজেকে ক্ষমা করার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন বলে কিছু আইনি বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, ট্রাম্পকে জরিমানা করা হতে পারে। এই বিচারের ফলাফল ট্রাম্পের কেবল ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য নয়, তার রাজনৈতিক ভাগ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আগামী ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে রিপাবলিকান পার্টি। ইতিমধ্যে পদপ্রার্থী হওয়া প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছেন ট্রাম্প। কিন্তু ১১ জুলাই সাজা ঘোষণা হওয়ার পরে তিনি আদৌ নির্বাচনে লড়তে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্ক দণ্ডবিধির ১৭৫ ধারা অনুযায়ী ব্যবসায়ী রেকর্ড জালিয়াতির একাধিক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল এই মামলায়। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর প্রতিটি নিউ ইয়র্কে ‘ই’ শ্রেণির বা সর্বনিম্ন স্তরের। সেক্ষেত্রে প্রতিটি অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ চার বছর করে কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন তিনি। তবে এই অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক কারাদণ্ডের বিধান নেই। ফলে ট্রাম্পের কারাগারে যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
নিউ ইয়র্ক আদালতের জুরি বোর্ডের সভাপতিত্বকারী বিচারক জুয়ান মার্চানের পরিচিতি রয়েছে ‘অপরাধীদের কঠোর সাজা’ দেওয়ার জন্য। তবে আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, এক্ষেত্রে ৭৭ বছরের রিপাবলিকান নেতাকে শুধু জরিমানা দিয়েই ছাড় দিতে পারে আদালত। কারণ, প্রথমত তার বয়স, দ্বিতীয়ত, অপরাধের ধরন ‘অহিংস’ এবং তৃতীয়ত, এটাই তার প্রথম অপরাধ। তা ছাড়া দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক্ষেত্রে ট্রাম্পের প্রতি জুরি ‘বাড়তি সহানুভূতি’ দেখাতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। আপিল চলাকালে জামিন নিয়ে ট্রাম্পের মুক্ত জীবন কাটানোর সুযোগ আছে।
আগামী ১১ জুলাই শাস্তি ঘোষণার আগে ট্রাম্প আদালতে তার ‘চরিত্রের’ বিষয়ে পরিজন ও পরিচিতদের প্রশংসাপত্র পেশের সুযোগও পাবেন। আমেরিকার আইনে এমন প্রশংসাপত্রে শাস্তি লাঘব হওয়ার সুযোগ থাকে। জেলের সাজা হলেও এখনই তা কার্যকর না-ও হতে পারে। আমেরিকার আইন অনুযায়ী, এক্ষেত্রে ম্যানহাটনের রাষ্ট্রীয় আপিল আদালতে আবেদন জানিয়ে স্থগিতাদেশ পেতে পারেন ট্রাম্প। বস্তুত, রায় ঘোষণার পরেই বৃহস্পতিবার ট্রাম্প উচ্চতর আদালতে আবেদনের বার্তাও দিয়ে রেখেছেন। ট্রাম্পের আবেদন সম্পর্কে রায় জানাতে আপিল আদালতের এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে বলে আইনজীবীদের একাংশের মত। ততদিনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে যাবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারবেন ট্রাম্প?
শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে হলেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে বাধা থাকবে না ট্রাম্পের। কারণ, সে দেশের আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলার আসামিও দেশের সর্বোচ্চ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপযুক্ত। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার আইনের অধ্যাপক রিচার্ড এল. হাচেন বলেন, মার্কিন সংবিধানে এমন কোনো বিধান নেই যে, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এর কোনো পরিবর্তন হবে না। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তিনটি শর্তই প্রধান। এগুলো হচ্ছে—৩৫ বছর বয়স, আমেরিকার বংশোদ্ভূত এবং ১৪ বছর আমেরিকায় বসবাস করতে হবে।
হ্যাচেন বলেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল উলটে দেওয়ার ঘটনায় রাজ্য সরকারও ট্রাম্পকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারবে না। ব্যালটেও রাজ্য সরকার তাকে অযোগ্য করার কোনো ধারা যোগ করতে পারছে না। তবে সাজাপ্রাপ্ত নেতা যদি নির্বাচিত হন, তবে ভোটের পরে কংগ্রেসের দুই কক্ষে তাকে ইমপিচ করার প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। ঘটনাচক্রে ট্রাম্পের সাজা ঘোষণার কয়েক দিন পরই রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলন। ঐ সম্মেলনেই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার কথা রয়েছে। রিপাবলিকান নেতৃত্ব সর্বসম্মতভাবে প্রার্থীদের বিরোধিতা করে প্রস্তাব নিলে সমস্যা বাড়তে পারে ট্রাম্পের।
ট্রাম্প কি ভোট দিতে পারবেন?
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার পক্ষেই বেশির ভাগ মতামত এলেও জেল হলে তার নিজের ভোট দেওয়াই শঙ্কার মুখে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কিছু রাজ্যে ফৌজদারি অপরাধে কারাদণ্ডিতদের ভোট দেওয়ার বিধান আছে। ট্রাম্প বসবাস করেন ফ্লোরিডায়। সেখানকার বিধানটি হলো, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি সাজার মেয়াদ পূর্ণ করলে বা সব ধরনের অর্থদণ্ড পরিশোধ করলে তবেই ভোট দিতে পারবেন। আবার যে রাজ্যে ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেই রাজ্যের আইনের প্রতিও সম্মান দেখিয়ে থাকে ফ্লোরিডা। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের সাজা হয়েছে নিউ ইয়র্কে। সেখানকার আইন বলছে, ফৌজদারি অপরাধে কারাদণ্ডিত অবস্থায় কেউ ভোট দিতে পারবেন না। অর্থাত্, ট্রাম্পকে যদি এই মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং নির্বাচনের দিনও যদি তার কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ না হয়, তাহলে তার পক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে অর্থদণ্ড হলে তিনি ভোট দিতে পারবেন।
অন্য মামলাগুলোর কী অবস্থা
ট্রাম্পের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার প্রভাব তার অন্য তিনটি ফৌজদারি মামলার জন্য সামান্যই। নিউ ইয়র্কের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মধ্যেই সেগুলো চলতে থাকবে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল উলটে দেওয়া সংক্রান্ত মামলা স্থগিত আছে। কারণ সুপ্রিম কোর্ট তাকে সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়মুক্তি দিতে পারে। ফ্লোরিডায় সরকারি গোপন নথির মামলা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। জর্জিয়ার নির্বাচনি হস্তক্ষেপের মামলাটি আইনি জটিলতায় রয়েছে, যখন ট্রাম্প এবং তার সঙ্গে থাকা অন্য আসামিরা আটলান্টা এরিয়া প্রসিকিউটরকে অযোগ্য ঘোষণা করার চেষ্টা করেন। এই প্রসিকিউটরই অভিযোগ এনেছিলেন।