২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট রোগী ছিল প্রায় আড়াই লাখ। কিন্তু ২০২৩ সালে মাত্র এক বছরেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় প্রায় ৩ লাখ মানুষ। এই সংখ্যা শুধু হাসপাতালে ভর্তিদের। এর বাইরে ডেঙ্গু রোগে আরও অনেকে আক্রান্ত হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের। ২০২৩ সালে মশাবাহিত এ রোগে মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। এ বছর প্রথম সাড়ে তিন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা এর আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। এসব নির্দেশক সামনে রেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এডিস মশা নিধনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীদের চাপ পড়ে স্বাস্থ্য খাতে। গত বছর ডেঙ্গু রোগীর চাপে বেসামাল ছিল হাসপাতালগুলো। ইতিমধ্যে ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেশের সব হাসপাতাল যাতে প্রস্তুত রাখা হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার ‘ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ দেশের ১৫ জেলায় লার্ভা জরিপ করেছে। সেখানে দেখা গেছে এডিস মশা প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলে মশার লার্ভার ঘনত্ব কিছু ক্ষেত্রে শহরের চেয়েও বেশি। এডিস মশার মধ্যে ইজিপ্টি বেশি মাত্রায় ডেঙ্গু ছড়ায়। এখন প্রত্যন্ত এলাকায় এর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। যে চিত্র আমরা ঢাকা মহানগরীতে দেখেছি, সেটা এখন চট্টগ্রাম ও বরিশাল ছাড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় দেখা যাচ্ছে। পুরো দেশই এখন ডেঙ্গু ঝুঁকিময় এলাকা। ঢাকার বাইরে অনেকে একাধিক ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে। এভাবে এডিস মশা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে যাওয়া বা লার্ভার এমন ঘনত্বে বিপদ দেখছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, এডিস নিয়ন্ত্রণে ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে কিছুটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দেখা গেলেও গ্রামে তার কিছুই নেই। এখন দেশজুড়ে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। তাই পরিকল্পনায় সারা দেশকেই তার মধ্যে রাখতে হবে।
শনিবার ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৬২০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ভর্তি হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। আর ওই বছরে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছে মোট ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. আবদুল আলীম সময়ের আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এডিস মশা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। নগরকেন্দ্রিক এডিস মশার প্রজননকাল জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। কিন্তু এখন এডিস মশার প্রার্দুভাব সারা দেশে, সারা বছর দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষকে সচেতন করার কাজটি আর সেভাবে হচ্ছে না। কিন্তু চেষ্টাটা ধরে রাখতে হবে। এডিস ও কিউলেক্স মশা নিধনের জন্য আলাদা আলাদা কর্মসূচি রাখতে হবে। স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং শিক্ষাসহ সব বিভাগের মধ্যে সমন্বিত একটি উদ্যোগ দরকার, যা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান সময়ের আলোকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। এ নিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। মশা থেকে বাঁচলে, ডেঙ্গু থেকে বাঁচা যাবে। তবে মশক নিধনে তৎপরতা দেখা যায় না। তিনি বলেন, মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়ে গেলে তখন চিকিৎসা করাতে হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীকে মশারির নিচে রাখতে হবে। যাতে অন্য কেউ সংক্রমিত না হয়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
অধ্যাপক কামরুল বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত কর্মসূচি দরকার। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সবার সম্পৃক্ত থাকা দরকার। মশা নিধনে ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অকার্যকর মশার ওষুধ ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই। ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে মশক নিধন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। মশক নিধনে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসনকে মশক নিধনে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক কামরুল। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে আমাদের এবার আগে থেকেই সতর্ক না হয়ে কোনো উপায় নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের একদিকে যেমন মশা মারতে হবে, আবার অন্যদিকে প্রাদুর্ভাব কমাতে আমাদের আগে থেকেই সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। মশা মারার জন্য ওষুধ যেমন মানসম্পন্ন কিনতে হবে তেমনই আমাদের ভালো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।