চলতি বছরের শুরু থেকে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে বিভিন্ন ওষুধের দাম। গত সাত দিনে অ্যান্টিবায়োটিক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ভিটামিন, ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিন এবং ইনজেকশনসহ অন্তত ১৬টি ওষুধের দাম বেড়েছে। এই সময়ে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত আড়াই মাসের ব্যবধানে অন্তত ১২০ ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে।
রাজধানীর মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধের বাজার এবং বিভিন্ন এলাকার খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মতো দেশের ওষুধের বাজারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। কোম্পানিগুলো যখন-তখন ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের অভিযোগ, এমন পরিস্থিতির মধ্যেও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ওষুধের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের অভিযোগ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। তার মধ্যে ওষুধের দামেও ঊর্ধ্বগতি। ফলে আয়ের বড় অংশই ওষুধ কেনায় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
তারা বলছেন, সাধারণত ক্রেতাদের প্যাকেটভর্তি ওষুধের প্রয়োজন না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা প্যাকেটের গায়ের দাম দেখার সুযোগ পান না। এ ছাড়া অন্য পণ্যের মতো ওষুধের দাম সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণা না থাকায় দামাদামির ঘটনাও নেই। দোকানি যে দাম চাইছে সে দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফা প্রবণতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যা খুবই অনৈতিক। এ বিষয়ে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়াসহ মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনশিয়াল ড্রাগের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় রয়েছে ২১৯টি। তার মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। গতকাল শুক্রবার সরেজমিন রাজধানীর মিটফোর্ড, ফার্মগেট, শাহবাগ এবং বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ওষুধের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রস্রাবজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ইউকল ২ এমজি ট্যাবলেট ৩ থেকে ৫ টাকা করা হয়েছে। ফলে এক বক্স ৬০টির দাম ১৮০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং টনসিলাইটিসের জন্য ব্যবহৃত একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ৫০০ এমজির অ্যাজিন ক্যাপসুল প্রতি পিস ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। এক পাতার ৬টির দাম ২৭০ থেকে বেড়ে ৩৩০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ২২ শতাংশ।
হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের রোজিথ প্রতি পিস ক্যাপসুল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করা হয়েছে। এক পাতা ৬টির দাম ১৮০ থেকে বেড়ে ২১০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।দেশ ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০০ এমজির অ্যাজিলেট প্রতি পিস ৩০ থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা হয়েছে। ৬টির এক পাতা ১৮০ থেকে বেড়ে ২১০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এসি আই লিমিটেড কোম্পানির সেফিম-৩ ডিএস সাসপেনশন ৫০ এমএল বোতল ২৮১ থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা করা হয়েছে। বেড়েছে একই কোম্পানির গ্যাবারোল ৭৫ মিলি গ্রামের এক প্যাকেটের ৩০টি ক্যাপসুল ৫২৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা। বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
বেক্সিমকোর টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর ওষুধ ট্রানেটা ২.৫/১০০০ প্রতি পিস ১৩ থেকে বেড়ে ১৫ টাকা করা হয়েছে। একবক্স (২০ টি) ২৬০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ১৫ শতাংশ। একই কোম্পানির হৃদরোগের জন্য ব্যবহৃত রসুটিন ২০ মিলি গ্রামের প্রতি পিস বেড়েছে ২ টাকা করে। একবক্স ৩০টির দাম আগে ছিল ৯০০ টাকা। তা এখন বেড়ে ৯৬০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। অ্যাজমার সমস্যায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মনোকাস্ট ১০ এমজি প্রতি ক্যাপসুল বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা করে। যা আগে ছিল ১৫ টাকা।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ম্যাক্সরিন ০.৪ মি.গ্রা. ক্যাপসুল প্রতি পিস ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এক পাতা ১০টির দাম ১০০ থেকে বেড়ে ১২০ টাকা করা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ।
ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালসের ইউরোম্যাক্স ০.৪ মি.গ্রা. ক্যাপসুলের দাম প্রতি পিস ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বক্স ৩০টির দাম ৩০০ থেকে বেড়ে ৩৬০ টাকা করা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যথানাশক এরিয়ান অয়েনমেন্ট ১৫ গ্রাম টিউবের মূল্য ৭০ থেকে ৮৫ টাকা করা হয়েছে। একই কোম্পানির ফাইলোপেন ডি এস ক্যাপসুল প্রতি পিস ১২ থেকে ১৪ টাকা করা হয়েছে। স্কয়ারের এরোমাইসিন পেডিয়েট্রিক ৬০ এমএলের ড্রপ ৭০ থেকে বেড়ে ৭৫ টাকা হয়েছে।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের অ্যান্টাসিড প্লাস ২০০ মিলিগ্রামের সাসপেনশন সিরাপের দাম ৭৫ থেকে বাড়িয়ে ৯০ টাকা করা হয়েছে।
এরিস্ট্রো ফার্মা লিমিটেডের অ্যাভোল্যাক ওরাল সল্যুসন ১০০ এমএল ১৭৬ থেকে ২০০ টাকা হয়েছে। যা রোগীদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ব্যবহৃত হয়।
দোকানিরা বলছেন, এই ওষুধ গত এক বছরের মধ্যে চার দফায় দাম বেড়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম কয়েক মাস ১২০ টাকা ছিল। পরে ১৫০ টাকা করা হয়। এক সপ্তাহ আগে ১৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে তা এখন ২০০ টাকা করা হয়েছে।
ফার্মগেটের সুনান ফার্মা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক সৈয়দ সাদিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘নতুন বছরে অনেক ওষুধেরই দাম বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ওষুধের দাম বাড়ছে। আমরা আগে যে মূল্যে ওষুধগুলো কোম্পানি থেকে কিনতাম, তা এখন বেড়েছে দ্বিগুণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ গুণ দামও হয়ে গেছে। ওষুধের দাম বাড়ায় রোগীরা যেমন কষ্টের মধ্যে আছেন তেমনি আমরাও সমস্যায় আছি।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল মুক্তাদির সময়ের আলোকে বলেন, ‘ওষুধের সব কাঁচামাল বিদেশে থেকে আমদানি করতে হয়। এর খরচ ডলারের দামের ওপর নির্ভর করে। এক সময় ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। তা এখন বেড়ে অফিসিয়ালি ১১০ থেকে ১১১ টাকা হয়েছে। আমরা ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করতে ১১৯ থেকে ১২০ টাকায় ডলার কিনছি। স্বাভাবিকভাবেই ওষুধের কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহনসহ অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পর্যায়ক্রমে ওষুধের দাম বিন্যস্ত করা হচ্ছে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এমনিতেই ওষুধের দাম অনেক বেশি। কোনো কারণ ছাড়াই ওষুধের দাম বাড়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। এভাবে অযৌক্তিকভাবে ওষুধের দাম বাড়তে থাকলে সাধারণ রোগী, যারা স্বল্প আয়ের মানুষ ওষুধ কেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ সময়ের আলোকে বলেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের দাম এক পয়সাও বাড়েনি। তবে যেসব পণ্য আমরা বিদেশ থেকে আনি, সেগুলোর দাম বেড়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কিছু সমন্বয় করা হয়েছে। তবে বেশি বাড়তে দেওয়া হয়নি।’