মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাত রোজার আগে প্রায় ১০ হাজার প্রকারের পণ্যের দাম কমিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য। আর রোজার অন্যতম প্রধান পণ্য খেজুরের দাম কমিয়েছে ৪০ শতাংশ। শুধু এ দেশটিই নয়, মুসলিম বিশ্বের আরও অনেক দেশেই রোজার আগে পণ্যমূল্য কমানো হয়। এসব খবর শুনে দেশের মানুষের আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কারণ ওইসব দেশের ঠিক উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। দেশের ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটতে সারা বছর ওত পেতে থাকে-কখন আসবে রোজার মাস। বছর ঘুরে আবার এসেছে রোজার মাস এবং রীতিমতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে লুটপাটে নেমে পড়েছে ব্যবসায়ীরা।
এবার আরও আগে থেকেই নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল। আর রোজার আগ দিয়ে বাজার আরও টালমাটাল হয়ে পড়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের রোজার বাজার বেশি বেসামাল এবং এবারের রোজা হবে বেশি খরচে। কারণ গত বছরের রোজার আগের বাজারে যে পণ্যমূল্য ছিল, এবারে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এবারের রোজায় ভোক্তাকে হয় গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ খরচ করতে হবে, নতুবা কম পণ্য কিনে অল্প খেয়ে রোজা রাখতে হবে। এমনটিই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
কয়েকটি নিত্যপণ্যের মূল্যের পার্থক্যের চিত্র দেখলেই বোঝা যাবে কেমন খরচ হবে এবারের রোজায়। যেমন গত বছর সাধারণ মানের খেজুরের কেজি ছিল ১৫০-২০০ টকা, এবার সে খেজুরের কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা। ভালো মানের খেজুরের কেজি ছিল ৬০০-৭০০ টাকা, এবার তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪০০-১ হাজার ৫০০ টাকা। গত বছর যে আপেলের কেজি ছিল ২৫০-২৮০ টাকা, এবার সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। গতবারের ২০০-২২০ টাকার মাল্টার কেজি বেড়ে হয়েছে ৩২০-৩৫০ টাকা। গত বছর রোজার আগের চিনির কেজি ছিল ১১৫-১২০ টাকা, এবার ১৪৫-১৫০ টাকা; ছোলার কেজি ছিল ৯০-৯৫ টাকা, এবার ১১০-১১৫ টাকা; পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০-৪০ টাকা, এবার ৯০-১০০ টাকা। গত বছর আলুর কেজি ছিল ১৮-২০ টাকা, এবার ৩৫-৪০ টাকা। বেড়েছে মুরগির দামও। গত রোজায় সোনালি মুরগির কেজি ছিল ২৮০-৩০০ টাকা, এখন ৩৪০-৩৫০ টাকা। এ ছাড়া বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা।
এভাবে রোজাকেন্দ্রিক পণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যমূল্যই এবার বেড়েছে অত্যধিক। যদিও রোজার মাসখানেক আগে থেকেই সরকার বেশ কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো, খাদ্যপণ্য আমদানিতে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য ধারে এলসি খোলার সুযোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তবে এসব উদ্যোগের সুফল ব্যবসায়ীরা নিলেও দেশের সাধারণ ভোক্তার কোনো লাভ হয়নি। উল্টো ব্যবসায়ীরা আরও দাম বাড়িয়ে ভোক্তার কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, একটি প্রবাদ আছে-‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি’। আমার তো মনে হয়, প্রবাদ বাক্যটি এখন পরিবর্তন করে বলা উচিত-ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।’ কারণ রোজার মাসে ধর্মীয় আবেগ থেকেই মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব দেশেই যেখানে পণ্যমূল্য কমানো হয়, সেখানে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা দাম না কমিয়ে কীভাবে মুনাফা লুটে নেওয়া যায় সে চিন্তায় থাকে। ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে কবে রোজার মাস আসবে, আর দাম বাড়িয়ে লুটপাট করবে। এবারও রোজার আগে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফার লোভে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার শুল্ক কমালেও তার সুবিধাও নিচ্ছে কেবল ব্যবসায়ীরা। আসলে ব্যবসায়ীরা সবদিক থেকেই লাভবান হচ্ছে।
দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২২ লাখ টন। শুধু রোজায় দরকার হয় ৩ লাখ টন। উৎপাদন হয় ৩০ হাজার টনের মতো। বাকিটা আমদানি করে মেটাতে হয়। গত বছর এ সময় প্রতি কেজি চিনি কেনা গেছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। শুক্রবার বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়, অর্থাৎ চিনির কেজিতে অতিরিক্ত খরচ হবে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। বছরে প্রায় ২ লাখ টন ছোলা আমদানি হয়। রোজায় দরকার হয় ১ লাখ টন। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১২ টাকা দরে। সে হিসাবে এবার কেজিতে বেশি খরচ করতে হবে ১৫ থেকে ১৭ টাকা। গত বছর রোজার আগে অ্যাংকর ডালের কেজি ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়।
পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৫ লাখ টনের। উৎপাদনের পাশাপাশি ৮ থেকে ৯ লাখ টন আমদানি করতে হয়; যার সিংহভাগ আসে ভারত থেকে। ভারত রফতানি বন্ধ করায় দেশে এখন আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে। ফলে এখন দেশি পেঁয়াজের ওপর পুরোপুরি নির্ভর বাজার। তাতে দামও বেশ চড়া। গত বছর রোজার আগে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সেই দাম এখন প্রায় তিনগুণ। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২৫ টাকা দরে। কেজিতে বেশি খরচ হবে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।
ডালের মধ্যে এখন প্রতি কেজি মোটা, মাঝারি ও সরু দানার মসুর ১০৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে প্রতি কেজি অ্যাংকর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। আর মুগ ডালের কেজি পড়ছে ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা। বেসনের দামও বেড়েছে এবার অত্যধিক। ছোলার বেসনের কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, গত বছর যা ছিল ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। আর খেসারির বেসনের কেজি এবার ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, গত বছর দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা।শুক্রবার উপচেপড়া ভিড় ছিল বাজারে
রোজার আগের সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় শুক্রবার ঢাকার বাজারগুলোতে ক্রেতার ঢল নেমেছিল। অধিকাংশ ক্রেতাই এদিন রোজার প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনেছেন। তাই সকাল থেকে রাত অবধি নিত্যপণ্যের বাজার ছিল ক্রেতায় ঠাসা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের মালিক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আজ সারা দিন রোজার পণ্যই বেশি বিক্রি করেছি। ক্রেতারা বেশি কিনেছেন ছোলা, চিনি, ডাল, বেসন, তেল, আটা-ময়দা এবং বিভিন্ন প্রকারের মসলাজাতীয় পণ্য। দোকানে কোনো পণ্যের কমতি নেই, তবে গত বছরের চেয়ে সব প্রকারের পণ্যের দামই এবার বেশি।এ দোকানে পণ্য কিনতে এসেছিলেন রাজধানীর রাজাবাজার এলাকার হাবিবা খাতুন। সরকারি চাকুরে এ ক্রেতা সময়ের আলোকে বলেন, আমরা কর্মজীবী নারী। রোজার আগে বাজারে আসার আর সময় পাব না। তাই শুক্রবার এসেছি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে। বাজারে সব পণ্যের দাম এত বেশি যে শুনেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে।