একের পর এক দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এতে ভেঙে পড়ছে টানেলের ডেকোরেশন অবকাঠামো। যা সংস্কার ও রক্ষাবেক্ষণে বাড়ছে ব্যয়। ফলে চরম উৎকন্ঠায় রয়েছেন টানেল কর্তৃপচালকদের বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণেই মূলত এই দুর্ঘটনা বাড়ছে। গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় চালকরা গাড়ি চলাচলে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড ক্যামেরা বসানোর কোন বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন টানেল সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেলে স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার বেঁধে দেয়া হলেও মানছেন না অনেক চালক। ফলে উদ্বোধনের পর থেকে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। সেই থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানেলের ভেতরে-বাইরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯টি। এতে দু‘জন নিহত ও আহত হয়েছেন ২৩ জন।টানেল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, টানেলে সর্বশেষ দূর্ঘটনাটি ঘটে গত সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে। এ সময় বেপরোয়া গতির পণ্যবাহী একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টানেলের গায়ে ধাক্কা দেয়।
এতে টানেলের ডেকোরেশন বোর্ড ভেঙে যায়। ট্রাকটির ড্রাইভার ও হেলপার গুরুতর আহত হন। তারা চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ট্রাকটি চট্টগ্রাম থেকে আনোয়ারা প্রান্তে যাচ্ছিল। নিরাপত্তাকর্মীরা পরে ট্রাকটি জব্দ করে।এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি প্রাইভেটকার উল্টে টানেলের গায়ে ধাক্কা দেয়। পরে পেছন থেকে আসা আরও তিনটি প্রাইভেটকার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে টানেলের ডেকোরেশন বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগের দিন ১০ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে টানেলের ভেতর প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাসসহ একে একে পাঁচটি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে চারজন আহত হন।
এর আগে ৩০ জানুয়ারি ভোরে টানেলের সংযোগ সড়কের আনোয়ারা প্রান্তে ট্রাকের ধাক্কায় এক বাইসাইকেল আরোহী নিহত হন। আহত হন আরো দুই বাইসাইকেল আরোহী। ১৮ জানুয়ারি সকালে আনোয়ারা প্রান্ত থেকে পতেঙ্গা যাওয়ার পথে মুরগিবাহী একটি পিকআপ চাকা ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টানেলের টিউবে ধাক্কা দেয়। এতে ডেকোরেশন বোর্ড ভেঙে যায় এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের ক্ষতি হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা দু‘জন আহত হন।গত ১৬ জানুয়ারি টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে দ্রুতগতির মাইক্রোবাসের ধাক্কায় সিকিউরিটি পোস্ট গুঁড়িয়ে যায়। এতে দায়িত্বরত নৌবাহিনীর এক সদস্যসহ সাতজন আহত হন। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে টানেল সড়কের আনোয়ারা প্রান্তে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত ১০ নভেম্বর টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে ওয়াই জংশন-সংলগ্ন এলাকায় বাসের ধাক্কায় আবুল হোসেন নামে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা নিহত হন। ৩ নভেম্বর রাত ৯টায় টানেলের ভেতর বাসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায় একটি প্রাইভেট কার। এতে প্রাইভেট কারের ভেতর থাকা চার যাত্রী আহত হন।৩০ অক্টোবর আনোয়ারা প্রান্তে টোল প্লাজা-সংলগ্ন এলাকায় একটি প্রাডো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে গাড়িতে থাকা চালক আহত হন। আর এসব দূর্ঘটনায় কোন মামলাও হয়নি। ফলে একের পর এক দূর্ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন চালকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী (টোল-ট্রাফিক) তানভীর রিফা বলেন, গত বছরের ২৯ অক্টোবর যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর থেকে ১৯ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত টানেলে ৯টি দূর্ঘটনা ঘটেছে। মূলত কার রেসিং, টানেলের ভেতর গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা, নির্ধারিত গতিতে গাড়ি না চালিয়ে কম-বেশিতে চালানোর কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। গতি নিয়ন্ত্রনে টানেলে নেই ¯িপড ক্যামেরা। এতে পার পেয়ে যাচ্ছেন দুর্ঘটনায় জড়িতরা।কর্ণফুলী থানার এসআই বিল্লাল হোসেন জানান, টানেলে একের পর এক দূর্ঘটনা ঘটলেও থানায় কোন মামলা হয়নি। উদ্বোধনের দিন ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে টানেলের ভেতর হলিউড স্টাইলে ১০টি কার রেসিং প্রতিযোগিতায় মেতে উঠার ঘটনায় একটি মামলা করেছেন টানেল কর্তৃপক্ষ। ১ নভেম্বর রাতে সড়ক পরিবহণ আইনে দায়ের করা এই মামলায় কাউকে আসামিও করা হয়নি।
এ বিষয়ে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (বন্দর) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনাগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। দুই প্রান্তে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ৩ জন করে ৬ জন সার্জেন্ট, ১৮ জন কনস্টেবল কাজ করলেও দায়িত্ব পালনের জন্য ডেডিকেটেড কোন গাড়ি নেই। দুই প্রান্তে দুটি গাড়ি খুব দরকার বলে জানান তিনি।দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বাসের যাত্রী মামুনুল হক বলেন, ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে বাস টানেলে ঢুকলেই যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। অনেক চালকও খেই হারিয়ে ফেলছে। আর অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলাচল করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, টানেলে স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার হলেও অনেকেই এর কম-বেশি গতিতে চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য টানেলের ভেতর-বাইরে স্পিড ক্যামেরা বসানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে সিসি ক্যামেরা দিয়ে টানেলে যানবাহন মনিটরিং করা হচ্ছে। টানেলে মোট ১১০টি সিসি ক্যামেরা আছে। ঘন ঘন দুর্ঘটনা টানেলের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনা নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। বেড়েছে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও।কর্ণফুলী টানেল সাইট কার্যালয়ে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, স্টাফদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ সব খাত হিসাব করে নির্ধারণ হয় পরিচালন ব্যয়। তাছাড়া রয়েছে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। টানেলের আয়ের সঙ্গে হিসাব করলে এ ব্যয় ১৮ গুণ বেশি।
তিনি বলেন, ঘন ঘন দুর্ঘটনা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। যা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়াচ্ছে। আবার ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হচ্ছে। তবে একসময় পরিচালন ব্যয় কমবে। পাশাপাশি টোল খাত থেকেও আয় বাড়বে। এ জন্য চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক আট লেনে উন্নীতকরণ, মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর চালু, আনোয়ারা চায়না ইকোনমিক জোন চালু হতে হবে। ওই সময় পর্যন্ত পৌঁছতে আরও অনেক সময় লাগতে পারে।সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বলেন, চালুর সাড়ে তিন মাসেও আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। প্রতিদিন যা আয় হয় তার চেয়ে টানেল সংস্কার-রক্ষনাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় ১৮ গুণ বেশি। একদিকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যানবাহন চলাচল চারগুণ কম, অন্যদিকে ঘন ঘন দুর্ঘটনা ব্যয় বাড়াচ্ছে।
সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, টানেলে যানবাহন চলাচল শুরুর পর এক মাসে টানেল দিয়ে মোট এক লাখ ৭৪ হাজার ৮৭১টি গাড়ি পারাপার করেছে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে গাড়ি চলেছে পাঁচ হাজার ৮২৯টি। এসব যান চলাচলে টোল বাবদ আয় হয়েছে চার কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৫০ টাকা। আর এই সময় টানেলে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় হয় ৭১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা আয়ের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি।একইভাবে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ মাসে টানেলে যানবাহনের টোলবাবদ মোট আয় হয় ১২ কোটি ৪৯ লাখ ২৩ হাজার ১৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রথম মাসের তুলনায় টোলবাবদ পরবর্তী ২ মাস ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আয় আরও কমে যায়। এই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
অথচ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সমীক্ষা অনুযায়ী, টানেলে যান চলাচল শুরুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি চলতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। সে হিসাবে গড়ে প্রথম মাসে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার গাড়ি চলার কথা। প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল।এ বিষয়ে জানতে চাইলে টানেল প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, টানেল নির্মাণের লক্ষ্য ছিল শিল্পায়নে যোগাযোগের গতি উন্নত করা। আনোয়ারা প্রান্তে যখন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে এবং মহেশখালীসহ অন্যান্য পরিকল্পিত অবকাঠামোর কাজ শেষ হবে, তখন যান চলাচল আরো বাড়বে। আপাতত টানেলের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যান চলাচল ঠিক আছে। গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে। টানেলে টোল খাত থেকেই আয় হবে। এছাড়া আয়ের অন্য কোনো খাত নেই। তবে এখনো পরিচালন খাতে ব্যয় বেশি।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, টানেলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। টোল আদায়ের বর্তমান পদ্ধতি আরও আধুনিক করতে হবে। টানেলের সঙ্গে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন হওয়ার পাশাপাশি চলাচল বাড়লে আয় বাড়বে। তখন পরিচালন ব্যয়টা মুখ্য থাকবে না। আয়ের খাত বড় হবে। আতঙ্ক দেখা দিয়েছে টানেল পারাপারে যাত্রীদের মাঝেও।