এবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয়ভাবে না করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে এ নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীক এবং আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী থাকছে না। তাতে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে সরকারি দলের ‘একতরফা’ প্রভাব কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, বিএনপি শুধু নির্বাচনমুখী দলই নয়, এ দলের ভিত্তিই হলো জনগণ ও সুষ্ঠু ভোট। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পরপরই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দলকে অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বিএনপি ঘোষণা দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধীদের কাছ থেকে সরকারের ‘বৈধতা’ পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। এতে মনে হতে পারে, বিএনপি সরকারকে মেনে নিয়েছে। এর সুযোগ নেবে সরকার। আর নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নেতাদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা এখনো দোলাচলে রয়েছেন।
অবশ্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কোনো রকম আলোচনা হয়নি। সময় আসুক, তখন দেখা যাবে।
আক্ষেপ প্রকাশ করে সেলিমা রহমান বলেন, ‘নির্বাচনে গিয়েই–বা কী হবে, তারা (আওয়ামী লীগ) যে সহিংস দল তৈরি করেছে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তো যুদ্ধ করা যায় না। আমাদের তো আর অস্ত্র নেই। দেখেন, এমন একটা (সংসদ) নির্বাচন করেও তারা কী বাহবা নিচ্ছে, তাদের ভাব, কথায় কী অহংকার—ভাবতেও অবাক লাগে।’
বিএনপি ২০২১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারি দলের চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে প্রথম দিকে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপের’ অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর ধারাবাহিকতায় সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বর্জন করে। এরপর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় কুমিল্লায় মনিরুল হক, নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকারসহ অনেককে দলীয় পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখন নির্বাচন পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন দলের মাঠপর্যায়ের নেতা বা সাবেক জনপ্রতিনিধিদের অনেকে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও শ্যামনগর মহিলা দলের সভাপতি মোসাম্মত নূর জাহান পারভীন মনে করেন, বর্তমানে দেশের যে সার্বিক পরিস্থিতি, তাতে নির্বাচন করে কোনো লাভ হবে না।
এবার উপজেলা নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীক থাকবে না, ফলে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থীও থাকছে না। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নূর জাহান পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তার মধ্যেও তারা ভোট কাটবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্দোলনে ব্যর্থতা ও সংসদ নির্বাচনের পর মাঠের নেতা-কর্মীরা এখনো হতাশায়। নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ এখন মামলা, বিচার, সাজার রায় নিয়ে আদালতে যাওয়ার মধ্যে রয়েছেন। আরেকটি অংশ এখনো কারাগারে। আন্দোলনের কর্মসূচিও এখন সেভাবে নেই। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার কৌশল নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটি বড় ক্ষেত্র হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সভা-সমাবেশসহ একধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা থাকে।
এর বাইরেও আরেক রাজনৈতিক সুবিধার কথা জানান নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য ও কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবার আওয়ামী লীগের অনেকে উপজেলায় নির্বাচন করবে। সংসদ নির্বাচনে তাদের মধ্যে (আওয়ামী লীগ ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী) যে বিভক্তি হয়েছে, তা শিগগির মিটবে না। নির্বাচনে অংশ নিলে সেখান থেকে বিএনপির জন্য একটা সুবিধা আসতে পারে। তবে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা দলীয় সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দেব।’