রুটি-রুজির তাগিদে ঘরের বাইরে ছুটতে হয় ছবেদা বেওয়ার (৭০)। ঠিকমতো ঘুম ভাঙে না, ঘুমভরা চোখেই খুব ভোরে বের হন গরুর গোবর থেকে তৈরি জ্বালানী ‘দেইল্যা’ কিনতে।গ্রামের যে সব বাড়িতে গরু পালন করা হয় তাদের কাছ থেকে দেইল্যা কিনে ভ্যানে সাজিয়ে নাটোর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন।সারা দিনের আয়ে চালিয়ে নেন বিধবা ছবেদা বেগম এবং একমাত্র নাতি ও নাতবউ এর জীবন।এটাই হচ্ছে , নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের মদনহাট গ্রামের ভ্রাম্যমাণ দেইল্যা বেঁচে থাকার সংগ্রামের এক দিন-প্রতিদিনের গল্প।
তিনি দেখিয়েছেন, একজন পুরুষ যা করতে পারে, নারীর পক্ষেও তা করা সম্ভব। ভ্যান গাড়ির চালিয়ে ‘দেইল্যা’ বিক্রি করে জীবনের চাকা ঘোরান বৃদ্ধা ছবেদা বেগম।ভিক্ষা করে বাঁচতে চান না, বিধবা ভাতার টাকায় চলে না সংসার। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও নিজে ভ্যান চালিয়ে জ্বলানী (শুকনা গবর) বিক্রি করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন ছবেদা বেগম। প্রায় সত্তর বছরে এসেও থামেনি তার চলার গতি। স্বামী-সন্তান বলতে কেউ নেই। তাই রোদ-বৃষ্টি শীত কি গরম, এসব তার কাছে একই রকম মনে হয়। নিজের জায়গা জমি নেই। বসবাস করেন, গোদাই নদীর পাড়ে ছোট্ট ঘরে। যেখানে থাকেন সেটাও অন্য মানুষের বাড়ি সামনে। তাই গালমন্দ শুনেই সেখানে থাকতে হয় তাকে।
জানা যায়, নাটোর সদর উপজেলার উপজেলার মদনহাট মধ্যপাড়া গ্রাম শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে । প্রতিদিন সকালে ৭০ বছর বয়সী ছবেদা বেগম, ভ্যান চালিয়ে অজও পাড়া গায়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্বালানী (শুকনা গবর) কিনেন। সেই জ্বালানী নিয়ে ভ্যান চালিয়ে শহরের স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। এতে সারাদিনে ২০০ কিংবা ৩০০ টাকা আয় করেন। আয় করা আর বিধবা ভাতার টাকা এই দিয়েই চলে সংসার, ওষুধ পত্রসহ সবকিছু। অসুস্থ থাকলে ওইদিন আয় বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন কীভাবে চলবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েন তিনি।
এরপরেও বার্ধক্যের কাছে মাথা নত করেননি। ভিক্ষাবৃত্তিতে যাননি বরং পরিশ্রম করে বেঁচে আছেন নাটোর সদর উপজেলার মদনহাট গ্রামের বৃদ্ধা ছবেদা বেগম।কথা হয় তার নাতি শাহীনের সঙ্গে। তার মতে, প্রায় ৪৫বছর পূর্বে নানা আক্কাস আলী মারা যান। ঐ সময় তার তিন বছরের এক মেয়ে ছিল তাকে নিয়ে একটানা ৪৫ বছর ধরে জ্বালানি বিক্রি করে আসছে। তিনি আমার মা। অনেক বছর আগে তিনিও মারা যান। নানীর অসুখ হলে দেখার কেউ নাই, তাই আমাকে বিয়ে দিছে। স্ত্রী-সন্তান আর নানীকে নিয়ে এক সাথেই থাকি। কিন্তু দিন মুজুরের কাজ করে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই এই বয়সেও তার নানীকে ভ্যান চালিয়ে জ্বালানী বিক্রয় করতে হয়।
ওই গ্রামের প্রতিবেশী শফির মোল্লা বলেন, ছবেদা বেগম এর অভাবি সংসার তাই (ঘুটা -দেইল্যা) জ্বালানি বিক্রি করে চলে। যৌবন কালে স্বামী মৃত্যুর পর আর (কাজ-কাম) বিয়ে সাদী করে নাই। স্বামী-সন্তান নাই, এলাকার সবাই তাকে ভালো বাসে এবং তার ব্যাপারে খারাপ বলতে পারেনা কেউ। নাতিকে নিয়ে ওই নদীর ধারে বসবাস করে।ঘোড়াগাছা গ্রামের শাহিনা বেগম বলেন, ছবেদার বাড়ি নদীর ওপার সে ভ্যান চালিয়ে দেইল্যা (জ্বালানি) বিক্রি করে খায়। আমাগারে কাছ থেকে এক পন (৮০)টা ১শ টাকা দিয়ে নগদও নেয় আবার বাকীও নেয়। তা বাজারে বিক্রয় করে যা লাভ হয় তাই দিয়ে কোন রকম সংসার চলে তার।
স্থানীয় চা দোকানী জহুরুল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই মহিলা (নারী) আগে মাথায় করে এখন ভ্যানে করে দেইল্যা বিক্রি করে আমরা কিনি। এতে আমাদের জ্বালানী সাশ্রয় হয়।এ ব্যাপারে দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য মাসুদ পারভেজ সোহাগ বলেন, ছবেদা বেগম আমার ওয়ার্ডের সে মদনহাট মধ্য পাড়ার বাসিন্দা। তার দুরবস্থা দেখে তাকে বিধবা কার্ড করে দেয়া হয়েছে এবং স্থানীয়দের সহায়তায় একটি ভ্যান কিনে দেওয়া হয়। ছোট্র একটা ঘরে তার নাতি, নাত বৌ ও তাদের এক সন্তান নিয়ে বাস করে। আত্মীয় স্বজন আসলে সেখানে থাকার কষ্ট হয়। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটা ঘড় তার নামে বরাদ্দ দেওয়া যায়, তার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করব।