ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস তাদের প্রার্থী তালিকায় ৪২ আসনের মধ্যে ২৬ আসনে নতুন মুখ এনেছে। এই নতুন প্রার্থীদের মধ্যে বেশ কিছু এমন প্রার্থী আছেন, যাঁদের নাম অতীতে খুব কম মানুষই শুনেছেন। আবার বেশ কিছু পুরোনো সংসদ সদস্যকে প্রার্থী করা হয়েছে। এই তালিকা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এর মধ্যে বড় আলোচনা হচ্ছে, বেশ কিছু আসনে তৃণমূল কংগ্রেস ভালো প্রার্থী না দিয়ে বিজেপি, এমনকি কংগ্রেসকে ছেড়ে দিচ্ছে কি না।
প্রার্থী তালিকায় পুরোনো ও অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রয়েছেন কলকাতা দক্ষিণ থেকে মালা রায়, কলকাতা উত্তর থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণনগর থেকে মহুয়া মৈত্র, মুর্শিদাবাদ থেকে আবু তাহের খান, বারাসাতে কাকলি ঘোষ দস্তিদার, জলপাইগুড়িতে নির্মল রায় বা দমদম থেকে সৌগত রায়, ডায়মন্ড হারবার আসনে দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
আবার বাংলার রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন কিছু মুখকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন ১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় কীর্তি আজাদকে বর্ধমান পূর্ব আসন থেকে বা আরেক ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুর থেকে, অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হুগলি থেকে, গোপাল লামাকে দার্জিলিং থেকে বা অক্সফোর্ডের ছাত্র শাহনওয়াজ আলি রায়হানকে মালদা দক্ষিণ থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রতিটি মুখই অবাক করেছে রাজ্যের মানুষকে। বিজেপি থেকে তৃণমূলে আসা বেশ কিছু নেতা জায়গা পেয়েছেন প্রার্থী তালিকায়। এঁদের মধ্যে রয়েছেন একসময় কংগ্রেস করা বিজেপির নেতা বালুরঘাটের বিপ্লব মিত্র, বনগাঁর বিশ্বজিৎ দাস বা রানাঘাটের মুকুটমণি অধিকারী। তাঁরা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে এসেছেন।
সদ্য স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া কলকাতা হাইকোর্টের বিতর্কিত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল দাঁড় করিয়েছে তাঁদের যুবদলের অন্যতম প্রধান মুখ দেবাংশু ভট্টাচার্যকে। অল্পবয়সী প্রতিনিধিদের মধ্যে রয়েছেন যাদবপুরে যুবদলের সভানেত্রী সায়নী ঘোষ, মেদিনীপুরের ঘাটালে অভিনেতা দেব যিনি অবশ্য আগেও সংসদ সদস্য ছিলেন, মথুরাপুরে বাপি হালদার বা মালদা দক্ষিণে রায়হান। সংখ্যালঘু মুসলিম প্রার্থীদের সংখ্যা সাত থেকে কমে পাঁচে নেমেছে।
পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, অন্তত ১০টি এমন আসন রয়েছে, যেখানে তৃণমূল অভিজ্ঞ ও পোড় খাওয়া নেতাদের বাদ দিয়ে প্রার্থী করেছে অপরিচিত, স্বল্প অভিজ্ঞ বা একেবারেই আনকোরা নতুন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীকে। এদের মধ্যে রয়েছেন বর্ধমান পূর্ব আসনের প্রার্থী ও পেশায় মনস্তত্ত্ববিদ শর্মিলা সরকার, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অপরিচিত মুখ কীর্তি আজাদ ও ইউসুফ পাঠান, একসময় বিজেপির সঙ্গে যুক্ত বিষ্ণুপুরের প্রার্থী সুজাতা মণ্ডল খান, অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরামবাগ আসনে মিতালী বাগ, কাঁথিতে উত্তম হালদার, ঝাড়গ্রামে কালিপদ সরেন, মেদিনীপুরে অভিনেত্রী জুন মালিয়া, বাঁকুড়ায় অরূপ চক্রবর্তী।
এসব প্রার্থীর মধ্যে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়িয়েছেন বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে, যাঁকে কার্যত ওয়াকবার দেওয়াই মনে করছেন অনেকে। আবার রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বহরমপুরে প্রার্থী করা হয়েছে ইউসুফ পাঠানকে। এই প্রার্থী দিয়ে কি কার্যত অধীর চৌধুরীকে জিতিয়ে দিলেন মমতা? এ প্রশ্নও উঠছে। অধীর চৌধুরী নিজে একটু মজা করেই অবশ্য বলেছেন, ইউসুফ পাঠান দাঁড়ানোয় তিনি খুশি। কারণ, এর ফলে তিনি বিখ্যাত হয়ে যাবেন।
এসব আনকোরা প্রার্থীর কেউ কেউ অবশ্য রাজনীতিতে আগেই পা রেখেছেন। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠছে, কেন এমন অনেককে প্রার্থী করা হলো, যাঁরা খুব একটা পরিচিত মুখ নন? তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি। তবে ব্যারাকপুর আসনে তৃণমূলের সংসদ সদস্য অর্জুন সিং বলেছেন, দিদি যা ভালো মনে করেছেন, তা–ই করেছেন। অর্জুন সিং নিজে এবার মনোনয়ন পাননি এবং স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট। অতীতে তিনি বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়েও নির্বাচন জিতেছেন। প্রশ্ন হলো, তিনি আবার দল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে ব্যারাকপুর আসনে দাঁড়াবেন কি না। এই একই প্রশ্ন তৃণমূলের আরও অনেকের সম্পর্কেই করা যায়, যাঁরা আজ মনোনয়ন পাননি।
এসব বঞ্চিত নেতার কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসন ঘোষণার ফাঁকে বলেছেন, ‘আমি মনের মতো প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তবে দু–একজনকে দিতে পারিনি। এ জন্য আমি দুঃখিত। তবে সামনেই বিধানসভা নির্বাচন (২০২৬) আসছে। আমি চেষ্টা করব, এঁদের সেখানে প্রার্থী করার।’