নড়াইল পৌরসভায় সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট চালু হওয়ার পর গত চার বছরে ছয় মাসও চলেনি। জনগণের করের টাকায় বানানো এই শোধনাগার অচল হয়ে পড়ে থাকা নিয়ে পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্তৃপক্ষের কারও কোনো বিকার নেই। অথচ বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন পৌরবাসী।পানি শোধনাগারের এমন অচল দশা নিয়ে পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্তৃপক্ষ একে-অন্যকে দুষছে। পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, বারবার চেষ্টা করেও নানা যান্ত্রিক সমস্যার কারণে এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। আবার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভাষ্য হলো, ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় পরিশোধনাগারটি অকেজো হয়ে আছে।
পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নড়াইল পৌরসভার দেড় লাখ বাসিন্দার বিশুদ্ধ পানির সংকট মেটাতে শহরের হাতিরবাগান এলাকায় ২০১৪ সালের অক্টোবরে পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। নির্মাণ শেষে ২০২০ সালের প্রথম দিকে পৌরসভার কাছে এটি হস্তান্তর করা হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘৩৭ জেলা শহর পানি সরবরাহ প্রকল্পে’র আওতায় ১০ কোটি ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয়।
প্রকল্পের কাজ করে গোপালগঞ্জের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এইচ ই এমটি অ্যান্ড এস এস কনসোর্টিয়াম (জেভি) ও মনির ট্রেডার্স। এই পরিশোধনাগারে এতে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ ঘনমিটার পরিশুদ্ধ পানি উৎপাদন হওয়ার কথা। এটি দিয়ে নড়াইল পৌরসভার বাসিন্দাদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পানি সরবরাহ সম্ভব।শহরের রূপগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ভওয়াখালীর বাসিন্দা আবু সাইদ বলেন, পৌরসভা পরিচালিত পাম্প থেকে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা পানযোগ্য নয়। ওই পানির সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়লা আসে। অথচ এত টাকার তৈরি পানি শোধনাগারটি অকার্যকর পড়ে আছে।
পরিশোধনাগার পরিচালনার জন্য কাজ করেন পৌরসভার তিনজন কর্মচারী। তাঁরা হলেন মেকানিক মো. ফায়েক সরদার এবং পাম্প অপারেটর রতন কুমার দাস ও কামরুল ইসলাম। রতন কুমার ও কামরুল বলেন, ২০২০ সালের প্রথম দিকে চালু হওয়ার পর পানি শোধনাগারটি মাত্র তিন মাস সচল ছিল। এরপর বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান মেয়র আঞ্জুমান আরা দায়িত্ব গ্রহণের পর মেরামত করে আবার ২০২১ সালে চালু করেন। তখন সেটি সচল থাকে মাত্র দুই মাস। এরপর আর চলেনি।
রতন কুমার দাস ও কামরুল ইসলাম আরও বলেন, ওই প্ল্যান্টের প্রতিটি যন্ত্রপাতিই নিম্নমানের। ফিল্টারের মান ভালো নয়, কোনো রকম বালুমাটি দিয়ে ফিল্টার তৈরি। প্ল্যান্টের পাইপগুলো মনে হয় পুরোনো, রং করে এখানে বসানো হয়েছে। মোটর চালালে গড়গড় করে শব্দ হয়। বিদ্যুৎ লাইনও ত্রুটিপূর্ণ। এ ছাড়া শোধনাগার থেকে ময়লা পানি ড্রেন দিয়ে পুকুরে গিয়ে পড়বে, সেটিরও সংযোগ দেওয়া হয়নি। পৌরসভা থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগকে অনেক চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এসে দেখেও গেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এম আবু সালেহ প্রথমলানোর জন্য পৌরসভায় টেকনিক্যাল টিম নেই। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় অকেজো হয়ে আছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে চলত।জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পানি শোধনাগারটি বুঝে নেওয়ার সময়ে নড়াইল পৌরসভার সচিব ছিলেন বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওহাবুল আলম। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্ল্যান্টটি ভালোভাবে নির্মাণ হয়েছিল কি না, তা বুঝে নেওয়ার মতো টেকনিক্যাল হ্যান্ড পৌরসভায় নেই। তাই যাচাই করার সুযোগ ছিল না। বারবার চেষ্টা করেও নানা যান্ত্রিক সমস্যার কারণে এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন সচল করতে স্থানীয় সরকার বিভাগের ফ্রান্সের অর্থায়নে পরিচালিত সেভেন টাউন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। তাঁদের সহায়তায় ওটাকে চালু করা না গেলে নতুন করে ওই প্ল্যান্ট করতে হবে।
পৌরসভায় সক্ষমতা না থাকার পরও প্রকল্প বুঝে নেওয়া হলো কেন—এ প্রশ্নে মো. ওহাবুল আলম বলেন, তখনকার মেয়রের দায়িত্ব ছিল বুঝে নেওয়ার। তিনি মারা গেছেন। তখন তিনি যতটুকু বুঝেছেন, তা করেছেন।কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নড়াইল জেলার সাধারণ সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার জানামতে দেশের ৩৭টি জেলায় ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। অন্য জেলার প্রকল্পের কী অবস্থা জানি না। সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য এটি সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ও পৌরসভা উভয়ের অবহেলার কারণে এত ভালো উদ্যোগ সফল হয়নি। এটিকে কীভাবে সচল করা যায় তার পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। এ ছাড়া এত টাকা অপচয় হলো। এর তদন্ত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’