Skip to content

সুন্দরবনের পুকুরগুলোতে লবনপানি অপসারনে সেচ শুরু 

    সুন্দরবনের পুকুরগুলোতে লবনপানি অপসারনে সেচ শুরু prothomasha.com

    নজীর বিহীন জলোচ্ছাসসহ দীর্ঘ ঘুর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রক্ষা কবজ সুন্দরবন থেকে আরও ৩৮ টি হরিণের মৃতদেহ বনবিভাগ উদ্ধার করেছে। এনিয়ে রিমেল আঘাত হানার ৭ দিনে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩৪টি হরিণের এবং ৪ টি শুকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হর। এসময়ে ১৮ টি আহত হরিণ ও ১ টি অজগর সাপ উদ্ধার করে শুশ্রুষার পর বনে অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে বাঘের কোন মৃতদেহ এখনওপর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন।

    তিনি বলেন, সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, পক্ষীরচর, ডিমের চর, সেলারচর, দাশেরভারানী, চান্দেশ্বর, দুবলা জেলেপল্লী, ও নারকেলবাড়িয়া থেকে এপর্যন্ত পর্যন্ত ১৩৪ টি হরিণ ও ৪ টি শুকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এসময় আহত অবস্থায় উদ্ধার ১৮ টি হরিণ ও ১ অজগর উদ্ধারের পর শুশ্রুষার করে বনে অবমুক্ত করা হয়েছে। উচ্চ জোয়ারের পানি সুন্দরবনের গহিনে চলে যাওয়ায় হরিণগুলো ভেসে গিয়ে সাঁতরে কূলে উঠতে পারেনি। এ কারণে হরিণগুলো মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছি। ঘুর্ণিঝড় রেমাল’র সময় অভূতপূর্ব জলোচ্ছাস ছিল। এত পানি আর কোনদিন সুন্দরবনে হয়নি। সেই সাথে ছিল দীর্ঘক্ষণ প্রবল বাতাস ও বৃষ্টি। তাই প্রাণীকূলের ও অবকাঠামোর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছি।’

    তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের বাঘ-হরিণসহ বণ্যপ্রাণী কূলের এবং বনজীবীসহ স্টাফদের ব্যবহারের মিষ্টি পানির ৮০ টি পুকুরের অধিকাংশ রেমালের প্রভাবে অতিরিক্ত জলচ্ছাসে তীব্রলবনাক্ত হয়ে গেছে। পুকুরের লবণাক্ততা দূর করাই এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা পুকুরগুলো লবণাক্ত পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ায় সেগুলো এখন আর বন্যপ্রাণী, বনজীবী এবং বনে অবস্থানরত বনকর্মীদের ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে সুন্দরবনের প্রাণীকূল, বনজীবী ও বন বিভাগের স্টাফদের খাবার পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্যাম্প এবং স্টেশনে কর্মরত বন কর্মীরা ৬ থেকে ৭ দিন যাবত গোসল এমনকি হাত-মুখ ধুঁতে পর্যন্ত পারছেন না।

    পুকুরের লবণাক্তটা দূর করার কোন সহজ উপায় নেই। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্প ও স্টেশনের লবণ পানিতে নিমজ্জিত পুকুরগুলোর লবণ পানি মেশিন লাগিয়ে সেচ দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়ার কাজ শুরু করেছি। পুকুরের সব পানি সেচ দিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়ার পর অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি পানিতে পুকুর ভরলে, তখন সেই পানি ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কাজেই এখন আমাদেরকে প্রকৃতির উপরে নির্ভর করে বৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে।’

    শরণখোলা রেঞ্জের এসিএফ মাহাবুব হাসান বলেন, পানির অভাবে যে কি কষ্ট হচ্ছে, যা বলে শেষ করা যাবে না। সব পুকুর লবনাক্ত। স্টাফরা হাত-মুখ পর্যন্ত পরিস্কার করতে পারছে না। সাগর উত্তাল থাকায় বাইরে থেকে পানি আনাও সম্ভব হচ্ছেনা।”সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, আসলে সিডর-আইলার চেয়েও এবার পানি অনেক বেশি ছিল। সুন্দরবনে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে এত পানি আগে কখনও দেখিনি। সাধারণ জোয়ারের চেয়ে অন্তত পাঁচ থেকে সাত ফুট বেশি উচ্চতায় পানি উঠে সুন্দরবনের প্রায় সব পুকুর তলিয়ে আছে।’ তাঁর ভাষায়, ‘রেমালের পর সুন্দরবনের প্রাণীকূলের পাশাপাশি আমাদেরও পানির অভাবে খুব কষ্ট হচ্ছে।”

    তবে বনপ্রেমীরা বলছেন, অনেক বণ্যপ্রাণী রেমালের আঘাতে মারা গেছে। মিঠা পানির উৎস পুকুর গুলো জলোচ্ছাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওযায় বনকর্মী ও বনজীবীদের পাশাশাশি বাঘ. হরিন, বানর, শুকরসহ বন্য প্রাণীদের সুপেয় পানির সংক সৃষ্টি হয়েছে। এতে বণ্যপ্রানীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত এবং নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হবার শঙ্কা রয়েছে।’

    প্রধান বন সংরক্ষক মো: আমীর হোসাইন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ ঘুর্ণিঝড় ও অতিরিক্ত জলোচ্ছাসে সুন্দবনের প্রাণী ও বনজীবীসহ স্টাফদের ব্যবহৃত মিষ্টি পানির পুকুর গুলো লবনাক্ত হয়ে গেছে। আমরা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সেচ কাজ শুরু করেছি। তবে বৃষ্টি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে প্রাকৃতিক কারনে।’ তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনের ৬ কোটি টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক চিত্র নিরুপনে বনবিভগর সকল স্টাফ একযোগে কাজ করছে।’

    প্রসঙ্গত: ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আমপানের কারণে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা সমুদ্রের নোনা জলে প্লাবিত হয়। পুকুরগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়ায় বন্যপ্রাণীরা সেই লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হয়। ওই সময় বাঘসহ বেশ কিছু বণ্যপ্রানী রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আবার মিষ্টি পানির সন্ধানে তারা লোকালয়ে এসে মারা পড়ে। তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে মিষ্টি পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যায়।এ অবস্থায় সুন্দরবনে বাঘসহ সকল বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানি পানে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে ৮০টি পুকুর পুন:খনন করা হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ বন বিভাগ বাঘ সংরক্ষণের জন্য ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’র আওতায় বন বিভাগ সুন্দরবনে মিষ্টি পানির উৎসগুলোকে পুনরুদ্ধার করে।

    সুন্দরবনই পৃথিবীর একমাত্র শ্বাসমূলীয় বন যেখানে বাঘ বসবাস করে। তবে, প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কারণে এই বনের প্রতিবেশ ক্রমশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হয় এবং এই বনের সুপেয় পানির উৎসগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে বন্যপ্রাণীরা সুপেয় পানি পান করতে অসুবিধায় পড়ে।
    সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ এর মতে, যখনই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে সুন্দরবনের সুপেয় পানির উৎসগুলো বিশেষ করে পুকুরগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়ে তখন বাঘ, বানর, হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হয়। বন্যপ্রাণীরা দীর্ঘদিন ধরে একটানা লবণাক্ত পানি পান করলে পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে আলসারে ভোগে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই বন্যপ্রাণীরা অকালে মারা যায়।