শেষ মুহূর্তে বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলের নেতৃত্বের শেষ সময়ের সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপির প্রায় অর্ধশত নেতা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে রয়েছেন। এখন তাঁদের নির্বাচন থেকে ফেরানো নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছেন নীতিনির্ধারকেরা। কারণ, প্রথম ধাপের নির্বাচনে প্রার্থীদের ফেরানো না গেলে পরের ধাপগুলোতে প্রার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে, তাতে দলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলা পরিষদে ভোট হবে। গত সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। বিকেল চারটা ছিল শেষ সময়। শেষ দিনে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ৪৫ জন নেতা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
এদিকে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটি সোমবার রাতে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। রাত ১০টায় স্থায়ী কমিটির সভা শুরু হয়ে সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় এক বিবৃতিতে স্থায়ী কমিটি জানায়, সভায় নির্বাচন কমিশন ঘোষিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়। সভা মনে করে, এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ে দলের যে সিদ্ধান্ত, সেটা পরিবর্তনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বিএনপি বলেছে, ‘এই অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না। সুতরাং এই উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নাই।’
দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে অস্পষ্টতা ছিল লক্ষণীয়। এতে নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্তিতে পড়েন। শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় পার হওয়ার সাড়ে আট ঘণ্টা পর বিএনপি সিদ্ধান্ত নিল যে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তারও ১১ ঘণ্টা পর গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হলো। এর আগেই দলটির প্রায় অর্ধশত নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এখন তাঁদের নির্বাচন থেকে ফেরাতে সাংগঠনিক খড়্গ আরোপসহ দলকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
বিএনপির নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি করল কেন, সে প্রশ্নে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘এখানে তো কোনো নির্বাচন নেই। সুতরাং অংশগ্রহণের প্রশ্নও নেই। বিএনপি যে উপজেলা নির্বাচনে যাবে না—সে বার্তা এমনিতেই আছে, তা সবাই জানে। তবু এটি দলীয়ভাবে বলার দরকার, সে জন্য বলা হয়েছে, এটুকই।’
তবে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এবার উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের বিষয়ে দল কতটা কঠোর হবে, তা নিশ্চিত নয়। এর আগে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় প্রায় ২০০ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। বিগত আন্দোলনের সময় তাঁদের অধিকাংশের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে দল। এবারের উপজেলা নির্বাচন দলের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আবার মাঠপর্যায়ের নেতাদের বহিষ্কার বা দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলে দল সাংগঠনিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান পদে আবারও প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির সভাপতি নগেন্দ্র চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, ‘আমি এই উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান। দলের নেতা-কর্মীসহ সবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। মাঠে কাজ করেছি, টাকাপয়সাও খরচ করেছি। নির্বাচন করব বলেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। তবে দলের সিদ্ধান্ত আমি জানি।’
বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, মূলত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনীহায় নির্বাচনে যাচ্ছে না বিএনপি। এর কারণ, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না–করার প্রশ্নে ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, দলের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ২৬৮ জনের সঙ্গে তারেক রহমান কথা বলেন। তাঁদের অধিকাংশই সংসদ নির্বাচন বর্জনের চার মাসের মাথায় উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মতামত দেন। কার্যত সে মতামতের ওপর ভিত্তি করে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক মাসুদুল আলম চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, ‘আমরা দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগতশীল। তার পরও অনেক সময় কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্থানীয় মতামতে ভিন্নতাও আসে। আমরা স্থানীয়ভাবে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
বিএনপির নেতৃত্বের ধারণা, এবার দলীয়ভাবে বিএনপির প্রার্থী খুব একটা থাকবে না। আর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ প্রার্থী হলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আগের মতোই দলের পদপদবি থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। তবে বিএনপির নেতৃত্বের ধারণা, দলের তৃণমূলের নেতারা আগের চেয়ে অনেক পোড় খাওয়া। তাঁরা এই সরকারের প্রহসনের নির্বাচনের ফাঁদে পা দেবেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের আহ্বানে ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট (সংসদ নির্বাচনে) দিতে যায়নি। এখন আমরা আবার মানুষকে ভোট দিতে যেতে বলব? তারা নৌকা বাদ দিয়ে নির্বাচনে নেমেছে। কারণ, মানুষ নৌকাকে বয়কট করছে, সে ভয়ে। কিন্তু নৌকা বাদ দিলে কী হবে, ভোট চুরির প্রকল্প তো রয়ে গেছে।’