চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমেছে। তবে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। তবে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রান্তিক জিডিপির পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিবিএস প্রান্তিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব করে, তাতে শিল্প, সেবা ও কৃষি—এই তিন খাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর মধ্যে বড় দুই খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় দেশের সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অক্টোবর-ডিসেম্বরে সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমেছে, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ১০ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ ছিল। আলোচ্য অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ।
শিল্পের মতো সেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের ৬ দশমিক ৬২ শতাংশের চেয়ে অর্ধেকের কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
শিল্প ও সেবায় প্রবৃদ্ধি কমার যত কারণ
শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ চলমান বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন কমেছে তেমনি রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি কম ছিল। এ ছাড়া ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগে স্থবিরতা আসে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসে সেবা খাতেও চাহিদা কমেছে। সব মিলিয়ে শিল্প ও সেবা খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার বাইরে শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমার প্রধান কারণ হলো বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া। এ সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশের চেয়ে কম। আমদানি বিধিনিষেধ এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে যখন চলতি ঋণের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে ওঠে, তখন এই ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে আটকে থাকে। ফলে সেটা সরবরাহ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমে যাওয়ার মতোই কাজ করে। মূলত এ কারণেই শিল্প ও সেবা খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।’
কৃষি খাত ভালো করেছে
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত যে সংকট মোকাবিলা করছে, সে তুলনায় কৃষিতে সংকট কম ছিল। পেঁয়াজসহ কৃষিপণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়েছে। আবার সবজিসহ দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যগুলোর দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া কৃষি খাতের উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য সরকারও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে কৃষকসহ কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষই কমবেশি লাভবান হয়েছে। বদৌলতে এ খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
এ নিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনীতিতে সংকটের মধ্যেও কৃষি খাতে সার, বীজ ও পানিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ঠিক রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার।শিল্প ও সেবা খাতে সংকটের যতটা প্রভাব ছিল, তার তুলনায় কৃষিতে কম ব্যাঘাত ঘটেছে।ফলে এ খাতে উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পণ্যমূল্যও বেড়েছে।ফলে এ খাতে মূল্য সংযোজন বেশি হয়েছে।তাঁর মতে, কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনীতি ও দেশের জন্য ইতিবাচক।এ খাতে প্রবৃদ্ধি যত বাড়বে, খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তত কমবে।