প্রান্তিক কৃষক নয়, শহর ও উপজেলার হিমাগারের মালিক ও অটো রাইস মিলে ঋণ দিয়ে ফেঁসে গেছে উত্তরাঞ্চলের জন্য বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ২১ শতাংশই এখন খেলাপি। পাশাপাশি উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত সুদে ঋণ দিয়ে বছরের পর বছর লোকসান করছে ব্যাংকটি। ফলে গত পাঁচ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।
আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত এই ব্যাংককে এখন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকই এখন এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে বিকেবির নিজের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশই এখন খেলাপি। পরিমাণের দিক থেকে যা ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।১৯৮৭ সালে বিকেবির তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের শাখাগুলো নিয়ে গঠন করা হয় রাকাব। বর্তমানে এটির বিস্তৃতি আছে রাজশাহী বিভাগ ভেঙে গঠিত রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতেও। তবে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ৩৭ বছর আগে বিকেবি ভেঙে রাকাব গঠিত হলেও এখন এই দুটি ব্যাংককে আবার একীভূত হতে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।রাকাব গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল, কৃষি খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক ১৬টি জেলার উন্নয়ন। এই ব্যাংকের ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ৩৩৩টি গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। রাকাবের নেটওয়ার্ক দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে রয়েছে। দেশের অন্য কোনো ব্যাংকের শাখা এত প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছেনি।
গত মাসের শুরুতে বিকেবি ও রাকাবকে একীভূত করার উদ্দেশ্যে ডাকা সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে যে গণমাধ্যমের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। তবে ব্যাংক দুটি সূত্রে জানা গেছে, ওই সভায় কর্মকর্তাদের ‘মুখে কুলুপ’ দেওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ফলে একীভূত হওয়ার বিষয়ে রাকাব থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আঞ্চলিক ব্যাংক হওয়ায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের চাপে হিমাগার ও অটো রাইস মিলে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যে অর্থ এখন আদায় হচ্ছে না। এ ছাড়া দক্ষ কর্মকর্তা ও জনবল সংকটের কারণেও যথাযথ ব্যাংকিং ব্যাহত হচ্ছে। তবে উত্তরাঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন, প্রাণিজ ও মৎস্য খাতে যে সাফল্য এসেছে, তার মূলে রয়েছে রাকাবের অর্থায়ন। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে গিয়ে ঋণ না দিলে কৃষকদের উৎপাদন ব্যাহত হতো।
ঋণের ২১ শতাংশ খেলাপি
রাকাবের প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে। সেখান থেকেই ১৬ জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যাংকটি। রাকাবের অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ৮২৪ কোটি টাকা। ১৮টি জোনাল কার্যালয়, ২ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা ও ১ হাজার ২৯৩ কর্মচারী এবং ৩৮৩টি শাখা নিয়ে চলছে এই ব্যাংকের কার্যক্রম। গত ডিসেম্বর শেষে রাকাবের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ,রাকাব আর্থিক হিসাব করে থাকে অর্থবছর ধরে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি ব্যাংকটি। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকটির তহবিল খরচ ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।
রাকাবের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহক হচ্ছে নীলফামারীর অঙ্কুর সিড অ্যান্ড হিমাগার। প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ৪৭ কোটি টাকা। এর পরই রংপুরের পীরগঞ্জের শাহ ইসমাইল গাজী (রহ.) প্রা. লিমিটেডের কাছে ৪২ কোটি টাকা এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আশরাফ সিড স্টোরের কাছে ৪১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য খেলাপি হলো রাজশাহীর দুর্গাপুরের নিগার কোল্ডস্টোরেজ ৩১ কোটি, বগুড়ার আল ফারুক ব্যাগস ২৬ কোটি, শেরপুরের অ্যাগ্রো আর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ২৫ কোটি, রংপুরের শাহ আমানত স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ ২৪ কোটি, ফুলবাড়ী কোল্ডস্টোরেজ ২০ কোটি, রংপুরের তারাগঞ্জের জিএসএ অটো ব্রিকস ১৯ কোটি, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র ১৫ কোটি, শেরপুরের একনিজ ফিল্ড মিলস ১২ কোটি ও নওগাঁর মাহমুদ হোসেন কোল্ড স্টোরেজ ৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ২৭৪ কোটি টাকা।
৫ বছরে লোকসান ১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা
ব্যাংকটি এখন ঋণের সুদ থেকে যে আয় করছে, তার কিছুটা কম টাকা আমানতকারীদের পরিশোধ করছে। তবে উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ও পরিচালন খরচ মিলে বছর শেষে বড় লোকসানে পড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাকাব লোকসান করে ৪৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে লোকসান বিপুল পরিমাণে বেড়ে হয় ৬১৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে লোকসান হয় ৪৮৪ কোটি টাকা ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪৫ কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ সাময়িক হিসাবে লোকসান হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা। বড় লোকসানের কারণে ব্যাংকটি বড় মূলধন ঘাটতিতেও পড়েছে।
সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে রাকাবকেও আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে উচ্চ সুদে। অন্যদিকে সরকার নির্ধারিত সুদহারে ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকটি। বর্তমানে যেখানে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, সেখানে কৃষি ও পল্লি ঋণে সুদহার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ সুদ খাতে ব্যাংকের আয় কম হচ্ছে। ,ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাকাবের পরিচালনা মডেলে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল। তাঁদের মতে, সরকার ব্যাংকটিতে বারবার মূলধন জোগান না দিয়ে কৃষকের ঋণের সুদে ভর্তুকি দিলেই সমস্যা কেটে যেতে পারে। এতে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হবে, স্বচ্ছতাও বাড়বে।
আলাউদ্দিন এ মজিদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে রাকাব ও বেসিক ব্যাংকে কাজ করেছেন। পাশাপাশি বিকেবি ও বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বলেন, ব্যাংক দুটি আবার এক করে কোনো ফল আসবে না। উত্তরাঞ্চল থেকে উল্টো প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমার প্রস্তাব—যেসব শাখা অলস পড়ে রয়েছে, এসব শাখা বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তারা এসব শাখার মাধ্যমে কৃষি অর্থায়ন করবে। এতে কৃষকেরা উপকৃত হবেন। ব্যাংকও এ থেকে মুনাফা করতে পারে। আলাউদ্দিন এ মজিদ আরও বলেন, সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এসব বিশেষায়িত ব্যাংক বাণিজ্যিকভাবে চলবে, নাকি কম সুদে কৃষকদের ঋণ দিয়ে চলবে। কম সুদে ঋণ দিতে হলে সরকারকে সুদ ভর্তুকি দিতে হবে। এ ছাড়া এই দুটি ব্যাংক থেকে মুনাফার মুখ দেখা কঠিন। পাশাপাশি ব্যাংক দুটি পেশাদারভাবে চলতে হবে।