সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৌতুক সম্প্রতি বেশ দেখা যাচ্ছে। সেটা দিয়েই শুরু করি। আমেরিকার পুরুষের একটা বউ আর একটা গার্লফ্রেন্ড থাকে। কিন্তু সে ভালোবাসে তার বউকে। ইউরোপের পুরুষদেরও একটা বউ আর একটা গার্লফ্রেন্ড থাকে। তবে সে ভালোবাসে তার গার্লফ্রেন্ডকে। সৌদি পুরুষের কোনো গার্লফ্রেন্ড থাকে না, বউ থাকে চারটা। কিন্তু সে ভালোবাসে তার উটকে। বাংলাদেশের পুরুষের বউ থাকে একটা, গার্লফ্রেন্ড থাকে চারটা। কিন্তু সে ভালোবাসে তার মাকে।’ বাংলাদেশের অনেক নারীই এই কৌতুক শেয়ার করছেন ‘সারকাস্টিকভাবে’। এসব পোস্টে সহমত পোষণ করছেন আরও অনেক নারী। কেউ কেউ কমেন্টেও সারকাজম করতে ভুলছেন না। কেন এই পোস্ট শেয়ার দিয়েছেন, জানতে চাইলে বেসরকারি চাকরিজীবী সোমা সাহা বলেন, কৌতুক হলেও বাংলাদেশের পুরুষদের যে বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে বলা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা নয়। বাংলাদেশের পুরুষদের একটা বড় অংশ স্ত্রীকে ভালোবাসবে নাকি মাকে, তা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন।
সোমার কাছেই জানতে চাই, আসলে কাকে ভালোবাসা উচিত? সোমা বলেন, ‘মা আর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তো দুই ধরনের। একজনকে ভালোবাসতে গেলে আরেকজনের ভাগে কম কেন পড়বে? কেন বাংলাদেশের পুরুষেরা মা আর স্ত্রীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন?’ একমত হলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা আতিয়া নূরও। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা টেনে তিনি বলেন, বিয়ের পর তাঁরা যৌথ পরিবারে ছিলেন। যে পরিবারের প্রধান ছিলেন শ্বশুর, আর সংসারের প্রধান ছিলেন শাশুড়ি। আতিয়া রান্না করলে সেটার প্রশংসা করতেন না স্বামী। বলতেন, ‘তোমার রান্না মজা বললে আম্মা মন খারাপ করবে।’ বিপরীত চিত্রও অবশ্য আছে। ফেসবুকে নারীদের আলোচনার বিভিন্ন গ্রুপে এ–সংক্রান্ত অনেক সমস্যা উঠে আসতে দেখা যায়। যেখানে বিয়ের পর স্ত্রীকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে মায়ের বিরাগভাজন হয়েছেন অনেক স্বামী। ফলে মায়ের মন রক্ষায় স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করতে হয়, কারও কারও সংসার ভাঙে, ছিঁড়ে যায় সম্পর্কের সুতাও।
বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘বউ গেলে বউ পাওয়া যাবে, মা গেলে কি মা পাওয়া যাবে?’ অনেকেই মনে করেন, মা যেহেতু কষ্ট করে বড় করেছেন, তাই তাঁর মন রক্ষা করা বা তাঁকে ভালোবাসা বেশি জরুরি। ঢাকার বাইরে চাকরি করেন রিয়াদ মোস্তফা। তাঁর মতে, সন্তানের জীবনে মা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্ত্রীর সঙ্গে কোনো মতেই মায়ের তুলনা হওয়া উচিত নয়। বিয়ের পরই সন্তানের সঙ্গে মায়ের দূরত্ব তৈরি হয়, সে জন্য বিয়ের রাতেই তিনি স্ত্রীকে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কাছে জানতে চাই, স্ত্রীর অবস্থানটা কী? রিয়াদ বলেন, ‘স্ত্রীকে বলেছি মায়ের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো কটু কথা শুনব না।’ ফেসবুকে বেশ কিছু নারীদের গ্রুপ রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হয় কিংবা নাম–পরিচয় লুকিয়ে নিজেদের সমস্যার কথা বলেন নারীরা। সেখানে প্রায়ই এমন সব সমস্যা উঠে আসে, যেখানে স্ত্রী আর মাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন স্বামীরা। এমনকি মায়ের কোনো আচরণের যৌক্তিক সমালোচনাও তাঁরা শুনতে রাজি নন। মায়ের সামান্য অভিযোগের সামনে গুঁড়িয়ে যায় তাঁদের দীর্ঘ বছরের প্রেম-ভালোবাসার প্রাসাদ। স্ত্রী যে তাঁর সন্তানেরও মা, অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীরা এটা ভুলে যান।
এ প্রসঙ্গে ফেসবুকে নারীদের লাইফস্টাইল গ্রুপ চৌরঙ্গী নেটওয়ার্কের প্রধান ঈশিতা পায়েল বলেন, তাঁদের নেটওয়ার্কের অনেক নারীই অ্যানোনিমাস পোস্টের সুযোগ নিয়ে নিজেদের মনের কষ্টের কথা লেখেন। যেখানে অন্যতম সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে, মা ও স্ত্রীর বিষয়ে সাম্যবস্থা সৃষ্টি বা সহাবস্থান নিশ্চিত করতে না পারা। দেখা যায় যে মায়ের ভুল থাকলেও স্বামী তাঁকে অন্ধের মতো সমর্থন করেন। আবার যখন স্ত্রীকে সমর্থন করতে যান, তখন হয়তো মা-ই বলেন, ‘এমন সন্তান জন্ম দিলাম, যে মাকে বোঝে না।’ কেন বাংলাদেশের নারীরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন? কেনই বা পুরুষেরা স্ত্রী ও মায়ের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে চান? জানতে চেয়েছিলাম জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, এই সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশে হয়, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। সব দেশেই কমবেশি এ সমস্যা আছে। তবে তাঁরা এটা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছেন। যেমন পাশ্চাত্যে একক পরিবার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে, স্বতন্ত্র মানুষের ওপর গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
মানুষ যে এমন আচরণ করে, তার তিনটি কারণ আছে। প্রথমটি হলো, কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট বা জ্ঞানগত উন্নয়ন। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাটা সে দেখে আসে। সেখান থেকেই ধরে নেয় যে স্ত্রীর চেয়ে মায়ের অবস্থান ওপরে। একটা শিশুর যখন বিকাশ হয়, তখনই সে পরিবারের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ভূমিকাটা নির্দিষ্ট করে নেয়। দ্বিতীয়টি হলো, অবজারভেশনাল লার্নিং বা পর্যবেক্ষণগত শিক্ষা। অর্থাৎ শিশু যে ধারণা নিয়ে বড় হয়, সেটাকে সে চর্চা করতে শুরু করে। অর্থাৎ সে একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তার মায়ের প্রতি বাবার যে আচরণ সে দেখেছে, নিজের স্ত্রীর জন্য সেই ব্যবহারই সে নির্ধারণ করে। তৃতীয় ধাপে এসে তার এ ধারণা আরও পোক্ত হয়। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তার এই আচরণকে প্রভাবিত করে। ফলে তার ধারণা বা বিশ্বাস আরও শক্ত হয়, প্রকাশ্য হয়। সে ধরেই নেয় যে স্ত্রীর সঙ্গে সে যে আচরণ করছে বা মাকে যে জায়গায় দেখছে, সেটিই সঠিক।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় কি তাহলে নেই? জবাবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘খুব সহজে হয়তো সমস্যা কাটবে না। কারণ, এটা আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি।’ তবে প্রত্যেক মানুষকে তাঁর জন্য সমাজের নির্ধারিত চরিত্রের বাইরে থেকে দেখার প্রতি জোর দিতে বলেন তিনি, ‘অর্থাৎ স্ত্রীকে কেবল স্ত্রী না ভেবে স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। মায়ের ক্ষেত্রেও তা–ই। একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। সব স্কুলকে শেখাতে হবে যে প্রত্যেক মানুষকে স্বতন্ত্র হিসেবে বিচার করতে হবে।’ ঠিক তা–ই। মা ও স্ত্রী দুজনই স্বতন্ত্র মানুষ। দুজনেরই গুরুত্ব অপরিসীম। কেন তবে দুজনের মধ্যে তুলনা করা? কেনই বা দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা?