দুর্নীতির তালিকায় হেভিওয়েটদের নাম আসা এবং আর্থিক খাতে চলমান সংকট তীব্র হওয়ায় রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা নিয়ে জনমনে কৌত‚হল আছে। এনিয়ে দলটির উদ্যোগের বিষয়ে নানা ‘গুঞ্জন’ সামনে আসলেও মূলত বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ আছে তাদের কার্যক্রম।
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং সংসদ সদস্য নিহত আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের অভিযোগ এখন সর্বমহলে আলোচনার শীর্ষে। এর বাইরে দেশের অর্থনীতিতে সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নগতি, ব্যাংকে ডলার ও তারল্য সংকট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির গুঞ্জনের আলোচনাও মানুষের মুখে মুখে। এমতাবস্থায় রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশে অনুসন্ধানী টিম মাঠে নামানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
বিভিন্ন মহলে এমন গুঞ্জন শুরু হলেও এর কোনো ভিত্তি নেই বলে স্থায়ী কমিটির দুই এবং তিন প্রভাবশালী সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে। তারা বলছেন, ব্যক্তি পর্যায়ে দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করা বিএনপির কাজ নয়। কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হচ্ছে। যার ফলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিএনপি রাষ্ট্রের ক্ষতির জায়গাগুলো শনাক্ত করে দেওয়ার বিষয়ে জাতিকে অবহিত করতে পারে।
সূত্রমতে, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। নেতারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে কর্মীদের আশাবাদী করার চেষ্টা করছেন। প্রশ্নগুলো হচ্ছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযুক্তদের নামের তালিকা আরও বড় হবে কিনা? আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে কিনা? অর্থনেতিক সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে কিনা? নেতাকর্মীদের ওপর হামলা মামলা নির্যাতনের পরিমাণ কিছুটা কমবে কিনা? কার্যকরী আন্দোলনের জন্য মাঠে নামতে কত সময় লাগতে পারে? এবার ক্ষমতাসীনরা মেয়াদপূর্ণ করতে পারবে কিনা ইত্যাদি।নাম প্রকাশ না করার শর্তে চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক নেতা বলেন, নেতাকর্মীদের এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো তথ্য নেই নেতাদের কাছে। তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকার বেকায়দায় আছে বলে কর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।সূত্রমতে, বর্তমান পরিস্থিতি একটি সেল গঠন করে দুর্নীতির চিত্র সামনে আনার জন্য হাইকমান্ডের কাছে বেশ কয়েকজন নেতা পরামর্শ দিয়েছেন। এনিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু বিগত সময়ে নানা কারণে তদন্ত কমিটি, তথ্য সংগ্রহ কমিটি, নির্বাচন অনিয়ম পর্যবেক্ষণ কমিটিসহ নানা নামে তথ্য সংগ্রহের অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি। এজন্য নতুন করে কোনো অনুসন্ধানী কমিটি করার সম্ভাবনা নেই। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিএনপির দপ্তরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, ব্যক্তি পর্যায়ে দুর্নীতির অনুসন্ধানী কোনো কমিটি করার পরিকল্পনা নেই বিএনপির। এর কারণ হচ্ছে, বিগত সময়ে এ জাতীয় কমিটি কার্যক্রম ছিল শুধু কাগজে কলমে। কোনো কার্যকরী প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের তথ্য সংগ্রহের কমিটিও এখনো পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করতে পারেনি। সংখ্যালঘু নির্যাতন, মন্ত্রণালায় ভিত্তিক কার্যক্রম, মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে অনেক কমিটি হয়েছে। কিন্তু কোনো কমিটিও একটি কার্যকরী প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি। এই কমিটিগুলোর কার্যক্রমে ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ লাভবান হলেও দল উপকৃত হয়নি।
দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, সর্বশেষ তিনটি নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের কথা বলা হলেও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহে বিএনপির আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের অনিয়মের ১০ ঘণ্টার ফুটেজও নেই বিএনপির কাছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অনুসন্ধানী টিম তো ঘুমে ছিল। নির্বাচন শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও পরে রাতে নির্বাচন হয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়।
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কয়েকটি কারণে ক্ষমতাসীনরা যে চাপে আছে তা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হওয়ায় নেতাকর্মীরা একটি পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছে। সিনিয়র নেতারা বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে এই চাপ বাড়াতে আবারও আন্দোলনে নামার বিষয়ে ভাবছে। তবে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বিভিন্ন মধ্যমে শুধু জানতে পেরেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে চাপও দিয়েছে। এজন্যই ক্ষমতাসীনরা বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি সামনে এনেছে।
এবিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ অসংখ্য ‘অমানবিক’ কাজ করেছেন। এসব বিষয় সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চয়ই জানতো, কিন্তু তারা কিছু করেনি। এখন সরকার একটা আইওয়াশ করছে। এদের ঠিকই প্রটেকশন দেবে সরকার।