Skip to content

পানি আমদানি হচ্ছে বছরে লাখ ডলারের

    পানি আমদানি হচ্ছে বছরে লাখ ডলারের prothomasha.com

    গ্রাম হোক বা শহর—বিশুদ্ধ পানির চাহিদা এখন সবখানেই। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় বিশুদ্ধ পানি। একসময় বিশুদ্ধ পানির বড় উৎস ছিল ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক পানি। এখনো গ্রামাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিই বিশুদ্ধ পানির বড় উৎস। তবে শহর এলাকায় এ জায়গা দখল করে নিচ্ছে বোতলজাত পানি। আবার পানি বিশুদ্ধকরণের ফিল্টারও এখন ঘরে ঘরে। সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি আবার আমদানিও হচ্ছে। বছরে লাখ ডলার ব্যয় হচ্ছে বোতলজাত পানি আমদানিতে।

    বাংলাদেশে দুই ধরনের পানি আমদানি হয়—এক. প্রাকৃতিক খনিজ পানি। দুই. বিশুদ্ধ পানি। সুপারশপ ও অভিজাত স্টোরে পাওয়া যায় এই পানি, যা মূলত ব্যবহৃত হয় পাঁচ তারকা হোটেল ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশে আসা বিদেশি ও উচ্চবিত্তরাও এই পানির বড় গ্রাহক। আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে পানি আমদানি শুরু হয় প্রায় ২৫ বছর আগে। শুরুতে বিদেশি বোতলজাত পানির ব্যবহার ছিল খুবই কম। তবে ধীরে ধীরে আমদানি করা পানির ব্যবহার বাড়তে থাকে। শুরুর দিকে ইউনিভার্সাল ট্রেডিং হাউস ও ফুডেক্স ইন্টারন্যাশনাল বোতলজাত পানি আমদানি করে। এখন এই দুটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং কোম্পানি, হোলসেল ক্লাব লিমিটেডসহ ২০-২২টি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে পানি আমদানি করছে।

    বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ফ্রান্সের এভিয়ান ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি। ফ্রান্সের আল্পস পর্বতের ঝরনার পানি প্রাকৃতিকভাবে পরিশোধন করে বোতলজাত করে এভিয়ান কোম্পানি। বিশ্বখ্যাত এই ব্র্যান্ডের প্রাকৃতিক পানির কদর সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ফিজি, একুয়া পান্নাসহ নানা ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানিও আমদানি হচ্ছে। মূলত ৩৩০ মিলিলিটার, ৫০০ মিলিলিটার ও দেড় হাজার মিলিলিটারের বোতলে পানি আমদানি হয়।

    জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গত পাঁচ বছরের পানি আমদানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরে গড়ে সাড়ে তিন লাখ লিটার বিদেশি বোতলজাত পানি আমদানি হচ্ছে দেশে। এর মধ্যে অবশ্য গত বছর পানি আমদানি কিছুটা কমে গেছে। গত বছর বোতলজাত পানি আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার লিটার। গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি পানি আমদানি হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার লিটার। মূলত বাংলাদেশে ফ্রান্স, ফিজি ও ইতালির পানিই বেশি আমদানি হচ্ছে। এসব পানি বেশি আমদানি হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য থেকে।

    দামি পানি কারা ব্যবহার করছে, জানতে চাইলে শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল ট্রেডিং হাউসের উপমহাব্যবস্থাপক দ্বীন খাঁ কফিল বলেন, মূলত বিদেশি ও বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণির মানুষজন এই পানির বড় গ্রাহক। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যখন বাড়ে, তখন স্বাস্থ্যসচেতন পণ্য ব্যবহারের ঝোঁকও বেড়ে যায়। এ জন্যই আমদানি করা বিদেশি পানির বাজারও বড় হচ্ছে। গত বছর আমদানি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে দ্বীন খাঁ কফিল জানান, ডলারসংকটের কারণে আগের মতো আমদানির ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। এ কারণে গত বছর বিদেশি বোতলজাত পানি আমদানি কমেছে। তবে চাহিদা যে একেবারে কমে গেছে, তা বলা যাবে না।

    দামি পানি, ছোট্ট বাজার

    পানি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুযায়ী, দেশে বোতলজাত পানির বাজার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। এই বাজার নিয়মিত বড় হচ্ছে। তবে আমদানি পানির বাজার অবশ্য বেশি বড় নয়। রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, পানি আমদানিতে বছরে লাখ ডলারের বেশি ব্যয় হচ্ছে। ২০২৩ সালে পানি আমদানিতে ১ লাখ ১৫ হাজার ডলার ব্যয় হয়। শুল্কায়ন মূল্য ছিল ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

    গত পাঁচ বছরের হিসাবে, গড়ে প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখ লিটার বিদেশি বোতলজাত পানি ব্যবহার হচ্ছে দেশে। আমদানি করা বোতলজাত পানির পরিমাণভেদে গড় দাম কমবেশি হয়। যেমন ৫০০ মিলিলিটারের পানি বিক্রি হচ্ছে ২১৫ টাকায়। দেড় লিটারের পানি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকার বাজার রয়েছে বিদেশি পানির।

    বিদেশি পানি আমদানি ও ব্যবহার বিষয়ে জানতে চাইলে তারকা হোটেল ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসের (ওয়েস্টিন) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাখাওয়াত হোসেন  বলেন, তারকা হোটেলে যে বিদেশি অতিথিরা থাকেন, তাঁরা সব সময় বিদেশি পানি পান করেন। এ ছাড়া কিছু প্রবাসী বাংলাদেশিও দেশে এলে বিদেশি পানি পান করেন। এই গ্রাহকদের চাহিদার কারণে তারকা মানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা পানি রাখতে হয়। এ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

    আমদানিকারকের পক্ষে বোতলজাত পানি খালাসে নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান পিআর ট্রেডিং হাউস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিমল দত্ত  বলেন, বিদেশি দামি পানি এখন ১ ডলার ২০ সেন্ট দাম ধরে শুল্কায়ন করছে কাস্টমস। এতে প্রতি লিটার পানিতে শুল্ককর দিতে হয় ১১৭ টাকা।

    বোতলজাত পানির বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার

    বিশ্বের সব দেশেই বোতলজাত পানির অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড়। প্রতিটি দেশেই পানির স্থানীয় ব্র্যান্ড রয়েছে। এ কারণে বৈশ্বিক পানি আমদানি-রপ্তানির বাজারও খুব বেশি বড় নয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে পানি রপ্তানির বাজারের আকার ছিল ৪৩৩ কোটি ডলার।

    বিশ্বে পানি রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ফ্রান্স। মূলত প্রাকৃতিক খনিজ পানিই রপ্তানি করে তারা। এ ছাড়া চীন, ইতালি, বেলজিয়াম ও ফিজিও বড় রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পানি আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে দেশটি ১০২ কোটি ডলারের পানি আমদানি করে। এ ছাড়া হংকং, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসও বড় আমদানিকারক দেশ।

    বাংলাদেশ রপ্তানি করছে, তবে…

    দামি পানি আমদানি হলেও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিও হচ্ছে পানি। তবে আমদানির মতো প্রাকৃতিক পানি নয়, বোতলজাত বিশুদ্ধ খাবার পানি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। পানি রপ্তানি থেকে সামান্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বোতলজাত পানি রপ্তানি করে আসছে। তবে পরিমাণে কম। জাহাজভাড়া কমে যাওয়ার পর করোনাকালে রপ্তানি বেড়েছে গ্রুপটির। আর চলতি বছর পানি রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বা এমজিআই।

    প্রাণ গ্রুপ মাউন্ট ফ্রেশ ও ইউরো ফ্রেশ ব্র্যান্ড নামে বোতলজাত পানি রপ্তানি করছে। গ্রুপটি মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে, পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ আফ্রিকায় পানি রপ্তানি করছে। এমজিআই এ বছর দুটি চালান যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করেছে। গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেঘনা বেভারেজ লিমিটেড এ পানি রপ্তানি করে। সরাসরি রপ্তানি ছাড়াও বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজের রসদ সরবরাহের মাধ্যমেও পানি রপ্তানি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জাহাজের রসদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে বোতলজাত পানি নিয়ে তা জাহাজের নাবিকদের সরবরাহ করছে।

    জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল  বলেন, বোতলজাত পানি উৎপাদনে যা খরচ, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় পরিবহন-সরবরাহ ব্যবস্থায়। এ কারণে পানির রপ্তানি নির্ভর করে মূলত জাহাজভাড়ার ওপর। জাহাজভাড়া বাড়লে রপ্তানি কমে যায়, ভাড়া কমলে রপ্তানি বেড়ে যায়। এরপরও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বোতলজাত পানি রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।