Skip to content

পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেই পড়াশোনা, হরিজন থেকে ‘প্রথম’ আইনজীবী হলেন কৃষ্ণ

    পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেই পড়াশোনা, হরিজন থেকে ‘প্রথম’ আইনজীবী হলেন কৃষ্ণ prothomasha.com

    মা-বাবা দুজনই হরিজন সম্প্রদায়ের। পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীতে সমবয়সী অন্যরা মা-বাবার মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও কৃষ্ণ দাশ ছিলেন ব্যতিক্রম। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম তাঁকে পড়ালেখা থেকে দূরে সরাতে পারেনি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সেবক) হিসেবে কাজ করেছেন। জোগাড় করেছেন পড়াশোনার খরচ।

    সম্প্রতি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন তিনি। শুধু তা–ই নয়, হরিজন সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, হরিজনদের মধ্য থেকে কৃষ্ণই প্রথম আইনজীবী হয়েছেন।কৃষ্ণ দাশ বর্তমানে চট্টগ্রাম আদালতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। গত ৯ মার্চ বার কাউন্সিলে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভুঁইয়া তাঁকে গাউন পরিয়ে দেবেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁকে গাউন পরানোর কথা।

    জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী  বলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষ্ণ দাশই প্রথম হরিজন, যিনি দেশের আইনজীবী হয়েছেন। বিষয়টি জানানোর পর তাঁকে উৎসাহিত করতে জেলা ও দায়রা জজ নিজেই গাউন পরিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছায় তাঁকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যাতে পিছিয়ে পড়া অন্যরাও উৎসাহিত হয়।

    চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার বান্ডেল রোডের সেবক কলোনিতে অন্য আর দশজনের মতো কৃষ্ণ দাশের বেড়ে ওঠা। ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন কৃষ্ণ। এরপর ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন। আগে থেকেই কৃষ্ণের ইচ্ছা ছিল তিনি আইনজীবী হবেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সহায়তায় তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচালনাধীন। তাঁর কাছ থেকে নামমাত্র ভর্তি ফি নেওয়া হয়। পরে তাঁর বেতনও মওকুফ করা হয়। শুধু পরীক্ষার সময় ফিগুলো দিতে হতো।

    কৃষ্ণ দাশ জানান, তাঁর বাবা চিরঞ্জীব দাশ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন।২০১৪ সালে তিনি স্ট্রোক করেন। মা ছায়া দাশও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর মাকে একাই সংসার খরচ ও বাবার ওষুধের খরচ চালাতে হতো। কৃষ্ণ তখন তাঁর পড়াশোনা ও নিজের খরচ চালাতে হিমশিম খেয়ে ওঠেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বন্ধুরা যখন দামি গাড়ি করে ক্যাম্পাসে আসতেন, তখন কৃষ্ণ কখনো হেঁটে আবার কখনো কাজ শেষ করে দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে পৌঁছাতেন। কারণ, ক্লাসের আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। পরে বিকেলে আরও দুটি টিউশনি করতেন।

    ২০১৮ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবিতে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন কৃষ্ণ। এরপর চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরীর সঙ্গে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সাইমুল চৌধুরীও কৃষ্ণকে আগে থেকেই পড়াশোনাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করতেন।শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃষ্ণ দাশকে অনেক আগে থেকে চিনি। তার মধ্যে পড়াশোনার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তাঁর আগ্রহ দেখে তাঁকে নিয়মিত সহযোগিতাসহ উৎসাহ দিতাম।’

    অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষায় পাসের জন্য প্রথমে প্রিলিমিনারি, এরপর লিখিত ও সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেন। ৯ মার্চ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে প্রকাশিত পরীক্ষার ফলাফলে কৃষ্ণ দাশ অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এখন থেকে তিনি নিজেই মামলা পরিচালনা করতে পারবেন।হরিজন সম্প্রদায় চট্টগ্রামের প্রধান মায়াদিন সরদার বলেন, ‘কৃষ্ণ দাশ হরিজন সম্প্রদায়ের গর্ব। তাঁর এই সাফল্যে আমরাও গর্বিত। এ জন্য গত মঙ্গলবার তাঁকে সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছে। তিনিই দেশে হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম আইনজীবী।’

    ছেলের এত বড় অর্জন দেখে যেতে পারেননি বাবা চিরঞ্জীব দাশ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি মারা যান। কিন্তু মা ছায়া দাশ ছেলের এই অর্জনে অনেক খুশি। তিনি বলেন, ‘আজ আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে ছেলেকে মানুষ করেছি। আজ মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। ছেলে মানুষের জন্য যাতে কাজ করে।’

    মায়ের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন কৃষ্ণ দাশও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর জন্য কাজ করে যাব। তারা যাতে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যেতে পারে।’কৃষ্ণ দাশ বলেন, এত দূর আসার পেছনে প্রতিবেশী, সহপাঠী ও সহকর্মীদের ভালোবাসা তাঁর পাথেয় ছিল। হরিজন সম্প্রদায়ের হলেও কেউ তাঁকে হেয় করেননি। মাঝেমধ্যে কিছু বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও ভালোবাসার পাল্লাই বেশি ছিল বলে মনে করেন এ আইনজীবী।