Skip to content

দাম বেঁধেই দায় শেষ, বাস্তবায়নে ঠনঠন

    দাম বেঁধেই দায় শেষ, বাস্তবায়নে ঠনঠন prothomasha.com

    রমজানের শুরু থেকেই বাজার ‘ঠান্ডা’ রাখতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কোমর বেঁধে মাঠে নামে। বাণিজ্য, খাদ্য, শিল্প এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যখন একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের ছিল না কোনো হেলদোল। দরদাম স্থিতিশীল রাখতে বাজারে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের, তবে কাজের বেলায় তারা যেন ‘কুম্ভকর্ণ’। আচকা  চতুর্থ রমজানে এসে ঘুম ভাঙে তাদের।

    গত শুক্রবার বিকেলে ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেয় সংস্থাটি। ‘যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ’ করে দিয়েই যেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্ম শেষ, যার প্রমাণ মিলেছে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। যে প্রতিষ্ঠান দামের ফর্দ সাজিয়েছে, সেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের ছায়াও দেখা যায়নি বাজারে। দোকানে দোকানে ঝুলছে পুরোনো তালিকা। দাম নেওয়া হচ্ছে ইচ্ছেমতো। রাজধানীর অন্তত ছয়টি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই অধিদপ্তরের দাম মানছেন না। ২৯ পণ্যের মধ্যে একটিও নির্ধারিত দামে বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

    সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২৯ পণ্যের দামের তালিকা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মনগড়া। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা না বলেই রমজানে গণমাধ্যমের নজরে আসতে সংস্থাটি দাম নির্ধারণের মতো কৌশল নিয়েছে।

    ভোক্তারা বলছেন, শুধু মুখে না বলে সরকারের উচিত প্রতিটি ধাপে পণ্যের মজুত পর্যালোচনা করা এবং বাজারে যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত করা। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে মাঠে না নামালে অবস্থার বদল হবে না।

    এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, নির্দেশনা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কার্যকর করা কঠিন। কারণ, খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে নতুন দরের পণ্য পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগে। তাই তারা এখন উৎপাদন ও মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং এসব পর্যায়ে নির্ধারিত দাম কার্যকরের বিষয়ে বেশি মনোযোগী। এসব স্তরে দাম স্বাভাবিক হলে খুচরায় নির্ধারিত দর কার্যকর হবে বলে মনে করেন তারা।

    প্রভাব পড়েনি বাজারে

    গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় রাজধানীর চারটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে– মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সবজির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ২৯ পণ্যের দর নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে কার্যকর হয়নি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে এখনও বিক্রি হচ্ছে না কোনো পণ্য।

    রাজধানীর টাউন হল বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস গতকাল বিক্রি হয়েছে ৭৮০ টাকায়। অথচ গতকাল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দাম নির্ধারণ করে দেয় ৬৬৫ টাকা। এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির দাম ১৬৫ টাকা বেঁধে দেওয়া হলেও বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০০ টাকায়। খাসির মাংস ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা, বকরির (ছাগল) মাংস ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

    মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে গিয়ে দেখা গেছে, নির্ধারিত ৬০ টাকার কাঁচামরিচ ৮০ টাকায়, ১৮০ টাকার আদা ২০০ টাকায়, ১২০ টাকার রসুন ১৫০ টাকায়, ৯৮ টাকার ছোলা ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়, ৬৬ টাকার পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মুগডাল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা, মসুর ডাল ১১০ থেকে ১৩৫ টাকা, মটর ডাল ১৬০ টাকা এবং খেসারির ডাল ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।  প্রতি হালি ব্রয়লার মুরগির লাল ডিম ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, সাদা ডিম ৪০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম ৬৫ থেকে ৭০ টাকা,  হাঁসের ডিম ৬০ টাকা  দরে বিক্রি হচ্ছে।

    বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আলু মানভেদে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৮০, পেঁপে ৪০, করলা ১০০, পটোল ১০০, ঝিঙা ৮০, টমেটো ৬০-৭০, শিম ৪০-৬০, শসা ৬০, খিরা ৫০, মরিচ ৮০, ঢ্যাঁড়শ ৮০, ধনেপাতা ৮০-১০০, পেঁয়াজ কলি ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি হালি লেবু ৩০-৬০, প্রতিটি ফুলকপি ৫০, বাঁধাকপি ৪০ ও লাউ ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মুরগির মধ্যে ব্রয়লার প্রতি কেজি ২২০, সোনালি মুরগি ৩৫০ এবং দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

    মাছের বাজারেরও একই হাল। রুই প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৪২০, কাতল ৪০০, পাঙাশ ২০০ থেকে ২২০, তেলাপিয়া ২০০ থেকে ২২০,  পাবদা ৪৫০ থেকে ৬০০, পোয়া ৪০০ থেকে ৬০০, ট্যাংরা মাছ ৭৫০ থেকে ৮০০, পুঁটি ৫০০, মেনি ৬০০, বেলে ৬৫০ থেকে ৮০০, বোয়াল ৭৫০ থেকে ৮০০, আইড় ৮০০ থেকে ১২০০, চিতল মাছ ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

    মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের মুদি দোকানি আজিজুর রহমান বলেন, আমরা যে দামে কিনেছি, সেই দাম নির্ধারণ করে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি। তাই কমাতে পারছি না।

    সবজি বিক্রেতা আব্দুল মতিন বলেন, দাম নির্ধারণ করে কি আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? আলু আজকে কিনে এনেছি ৩২ টাকা কেজি। পাইকাররা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। গাড়ি ভাড়াও কিলোমিটার অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেন তাহলে দাম কমে যাবে।

    কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা মো. সুমন বলেন, সরকারকে বলেন ঘাটে আসতে। আমরা তাদের কাছ থেকে মাছ কিনব। তারপর তাদের নির্ধারিত দামে বিক্রি করব।

    দুই সংস্থার দুই রকম দর

    সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পণ্যমূল্য তালিকা প্রকাশ করলেও তা একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। আবার এই দুই তালিকায় স্থান পাওয়া বিভিন্ন পণ্যমূল্যের সঙ্গে খুচরা বাজারে বিক্রিতে রয়েছে বেশ ফারাক। যেমন– কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জাহিদি খেজুর ১৮৫ টাকা ৭ পয়সা বেঁধে দিয়েছে। তবে টিসিবির তথ্য অনুযায়ী গতকাল বাজারে সাধারণ মানের খেজুরেরই দাম ২৮০-৪৫০ টাকা।

    সারাবছর খবর নেই 

    কৃষি বিপণন আইনে এ সংস্থাকে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া আছে। ২০১৮ সালের এ আইনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যাবলিতে বলা হয়েছে, কৃষিপণ্যের দাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এ সংস্থার অন্যতম প্রধান কাজ। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এর পরও কৃষিপণ্যের বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে বাজারে খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে দাম নির্ধারণ করেই দায় শেষ করছে সংস্থাটি। অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত থাকা কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের কেউ-ই যান না বাজারে।

    কাজের মধ্যে শুধু একটি কাজই নিয়মিত করে সংস্থাটি। নিয়মিত ঢাকা শহরের দৈনিক পণ্যমূল্যের একটি তালিকা করে পাঠিয়ে দেয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে। অবশ্য এই একটি কাজেও রয়েছে বড় গলদ। প্রতিদিন দামের যে তালিকা দেওয়া হয়, সে দরের সঙ্গে বাজারে প্রকৃত দামের রয়েছে বিস্তর ফারাক।

    এ বিষয়ে ঢাকা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের জায়গাটা অনেক বড়, কিন্তু পাওয়ার (ক্ষমতা) নেই। কারণ আমরা ম্যাজিস্ট্রেটের মতো জরিমানা করতে পারি না। সে ক্ষমতা যেদিন পাব, তখন নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করব।

    তবে ঢাকা জেলায় বিভিন্ন তদারকি কাজে ম্যাজিস্ট্রেট বণ্টনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, গত সাত মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে কোনো চাহিদা পাইনি।

    তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ছয় ও ২০২২ সালে ৪০ পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তবে ওই সময় একটি পণ্যের দামও কার্যকর হয়নি। গত বছর আলুর দাম বেঁধে দেয় সংস্থাটি। আর সব শেষ ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও বাজারে তা কার্যকর হয়নি।

    কারা কী বলছেন

    দাম নির্ধারণ নিয়েও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সবার রয়েছে নানা অভিযোগ। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, গরু কিংবা খাসির মাংসের যৌক্তিক দাম নির্ধারণের আগে আমাদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খোন্দকার মো. মহসিন বলেন, ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণের আগে আমাদের ডাকা হয়নি। একই অভিযোগ করেছেন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা। কার পরামর্শে এমন দাম নির্ধারণ হয়েছে, তা জানেন না মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজাও।

    কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, আমরা দাম বেঁধে দিইনি, যৌক্তিক দাম কত হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সে অনুযায়ী সংস্থাগুলো অভিযান চালাবে, ব্যবস্থা নেবে। আমাদের জনবল সংকট আছে। তিনি বলেন, মাঠ থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করেই দাম নির্ধারণ করেছি। এই ২৯ পণ্যের দর সব অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে নির্ধারণ করা হয়েছে, ফলে বাস্তবায়ন সম্ভব।

    কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের দাম কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নেই। প্রতিষ্ঠানটিতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।

    জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্বও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। কৃষি বিপণন আইনেই তা স্পষ্ট। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইন অনেক ব্যাপক। শুধু নির্ধারিত দাম কার্যকর করা আমাদের কাজ নয়।

    সচেতনতা তৈরি, বাজারে প্রতারণা বন্ধ করা, পণ্যের মান ঠিক রাখাসহ নানা কাজ করা লাগে। এর মধ্যেও আমরা বাজার তদারকি করছি। আমাদের জনবল কম। রাত-দিন কাজ করছি। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অনেক জনবল, অনেক ক্ষমতা– তারা চাইলে বাজার তদারকিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, শনিবার সারাদেশে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ৫৫টি অভিযান চালিয়ে ১৪১ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে।