কুমিল্লা শহরে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় ১০ বছর বয়সী এক শিশুকে। ওই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। মামলার তদন্তে নেমে সন্দেহভাজন কয়েকজনের ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দেয় পুলিশ। তবে চার বছরের বেশি সময়েও পরীক্ষার প্রতিবেদন না পাওয়ায় তদন্ত সেখানেই আটকে আছে।
২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম শহরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় সাত বছরের এক শিশুকে। এ ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার একজন আদালতে অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, তদন্তের প্রাথমিক সব কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু ডিএনএ প্রতিবেদন না আসায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারছেন না।
শুধু এ দুটি মামলাই নয়, ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়ায় সারা দেশে বহু মামলার তদন্ত শেষ করতে পারছে না পুলিশ। সারা দেশে যেসব মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার দরকার হয়, সেগুলোর নমুনা পরীক্ষা হয় ঢাকার দুটি ল্যাবে। তার মধ্যে একটি ল্যাব বরাদ্দের অভাবে মাসখানেক ধরে বন্ধ আছে। এর ওপর সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সে কারণে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনের জন্য মামলার তদন্ত আটকে যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়ায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭৮৯টি মামলার তদন্ত আটকে ছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩২২টি মামলা চট্টগ্রাম মহানগরের।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব মামলায় ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য ১ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষায় আছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এর মধ্যে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়ায় সন্দেহভাজন অনেকেই দীর্ঘদিন কারাগারে আটক আছেন। অন্যদিকে বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগীর স্বজনেরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।
এ বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) পদে সদ্য পদোন্নতি পাওয়া পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশনস) মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেসব মামলার ডিএনএ প্রতিবেদন দরকার হয়, সেসব মামলায় অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এতে মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
প্রতিবেদন পেতে বিলম্ব কেন
চট্টগ্রামে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক নওশের কোরেশি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত শেষ। ২০২২ সালের অক্টোবরে শিশুটি খুন হওয়ার পরপরই ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু প্রতিবেদন এখনো আসেনি। সে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিচ্ছেন না। তাতে তদন্তও শেষ করা যাচ্ছে না। একই ভাষ্য কুমিল্লায় ১০ বছরের শিশুটি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. জাকির হোসেনের।এত দিন ডিএনএ পরীক্ষা হতো ঢাকার মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজসংলগ্ন ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে। সিআইডির ল্যাবটি চালু থাকলেও অন্যটি মাসখানেক ধরে বন্ধ রয়েছে। সেখানে কার্যক্রমটি পরিচালিত হতো মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর পরিচালিত মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের অধীনে। এ কাজে এত দিন অর্থায়ন করে আসছিল ডেনমার্কের সহায়তা সংস্থা ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ডানিডা)। তবে ডানিডার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের চুক্তি শেষ হওয়ায় অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে রি-এজেন্টের অভাবে পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এমন অবস্থায় বর্তমানে সারা দেশের সব মামলার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি মাত্র ল্যাব সচল রয়েছে। সিআইডির ওই ল্যাবে প্রতিদিন ২০টি নমুনার ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। ওই ল্যাবের দায়িত্বে থাকা বিশেষ পুলিশ সুপার ইমরান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বছরে তাঁদের কাছে ১০ হাজারের মতো মামলা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আসে। সে হিসাবে প্রতিদিন আসা মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩টির বেশি। এর ফলে সেগুলো পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়।
বাড়ছে মামলার জট
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার হয় ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুসারে। বিশেষ এই আইনে ডিএনএ ও রাসায়নিক পরীক্ষার বিষয়ে কোনো বিধান ছিল না। ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে এ-সংক্রান্ত নতুন বিধান যুক্ত করা হয়। আইনের ৩২-ক ধারায় বলা হয়, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াও ওই ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, তার ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।
সময়মতো ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন না আসায় মামলার জট বাড়ছে বলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন। দেশে শুধু সিআইডির ডিএনএ ল্যাব সচল থাকার বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ল্যাব স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সিফাত-ই-নূর খানম প্রথম আলোকে বলেন, সহিংসতার ঘটনায় অনেক ভুক্তভোগী মেডিকেল পরীক্ষা দেরিতে করেন। অনেকে অজান্তে আলামত নষ্ট করে ফেলেন। ফলে প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষা অবশ্যই জরুরি। তবে ল্যাবের সংখ্যা কম থাকায় এবং জনবল ঘাটতি থাকায় ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ থেকে ল্যাবে পরীক্ষা করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লাগিয়ে দেওয়া হয়। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে চাইলে অন্যান্য আইনি ধাপের মতো ডিএনএ পরীক্ষা দ্রুত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মামলায় দীর্ঘসূত্রতা আরও বাড়বে।