‘কবিতা এখন রাজপথে।’ ছাত্র আন্দোলনের মুহুর্মুহু ধাক্কায় রাষ্ট্র যখন কাঁপছে, দেয়ালে দেয়ালে স্লোগানটি লিখে দিয়েছিল ছাত্ররা, ১৯৬৮ সালে, প্যারিসে। পুরোনো পৃথিবী তারা ভেঙে তছনছ করে দিতে চেয়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল, পুরোনো পৃথিবী তাদের এগোনোর পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারিকেডের মতো। ছাত্ররা তাই লিখেছিল, ‘ব্যারিকেড রাস্তা বন্ধ করে, কিন্তু খুলে দেয় পথ।’ আগের দুনিয়া তারা ভেঙে ফেলতে চাইছিল নতুন এক দুনিয়ার তৃষ্ণায়। বিপ্লবী রুশ ভাবুক মিখাইল বাকুনিনের একটি কথা খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল তাদের, ‘ভাঙার আবেগ আসলে সৃষ্টিশীল আবেগ।’ ছাত্ররা ছিল সেই আবেগে কাতর। রাজপথে তারা লিখছিল কবিতা—স্বপ্নের আগুন দিয়ে, বিপ্লবী অক্ষরে।
এ বছরের জুলাই–আগস্ট মাসে ইতিহাসের একই আবর্তন আমরা দেখতে পেলাম, বাংলাদেশের রাজপথে। ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে লিখল আন্দোলনের কবিতা, নিজেদের জীবন দিয়ে। মুক্তির স্বপ্নে লাখে লাখে তারা নেমে এল পথে। সরকারের মুখোমুখি দাঁড়াল অদম্য সাহসে। নতুন নতুন চিন্তা ও কৌশলে প্রাণ সঞ্চার করে আন্দোলন টিকিয়ে রাখল। অবশেষে লৌহপ্রতিম সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়ল।
যতটা সরলভাবে চার–পাঁচ লাইনে গল্পটা বলা হলো, ঘটনা এত সহজ ছিল না। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পনেরো বছরের বেশি শাসনামলে শুধু কঠোর স্বৈরাচারীই হয়ে ওঠেননি, হয়ে উঠেছিলেন নির্মম এক নিপীড়ক। সীমাহীন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলকে তিনি দমন করেছিলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে পদানত করেছিলেন, নিবর্তনমূলক আইনে ও আইনবহির্ভূত পথে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করেছিলেন।
শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতার চরম রূপটি দেখা গিয়েছিল এই আন্দোলনের সময়ই। তাঁর রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এবং কয়েকটি বাহিনীকে এই রাষ্ট্রেরই নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যাপক এক হত্যাকাণ্ডে তিনি লিপ্ত করেন। এই হত্যাকাণ্ডের আয়োজন ছিল অকল্পনীয়, ঠিক যেন শত্রুগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক রাষ্ট্রের যুদ্ধ। রাষ্ট্র ও সরকারকে শেখ হাসিনা তাঁর দলের পকেটে রুমালের মতো গুঁজে দিয়েছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব সাহস দেখিয়ে বেঁকে বসল। তারা শুরু করেছিল সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক কোটাব্যবস্থারই বিরুদ্ধে। কিন্তু শেখ হাসিনার হঠকারিতা ছোট একটি গোষ্ঠীর দাবিকে জনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত কুশলী কর্মসূচি দিয়ে নানা শ্রেণি–পেশা–গোষ্ঠী–বয়সের জনতাকে তাদের সঙ্গে একাত্ম করতে সক্ষম হয়। সবাই নির্ভয়ে বুক পেতে দাঁড়ায় সরকারের নিষ্ঠুর হত্যাযন্ত্রের সামনে। জনতা যখন একটি এককাট্টা রাজনৈতিক সত্তা হয়ে সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে, কার সাধ্য তাকে ঠেকায়। বাকিটা তো ইতিহাস।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রদের সাহসী উত্থান ঘটেছে বারবার। বিষয়টি আলাদা একটি নিবিড় গবেষণার দাবি রাখে। সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের একটি অভূতপূর্ব তুলনা এ ক্ষেত্রে না করলেই নয়। উনিশ শতকে পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রভূমি কলকাতায় মধ্যশ্রেণি গড়ে ওঠার পর রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের মতো বহু আকর্ষণীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। তাঁরা প্রত্যেকে একেকটি ভাবাদর্শ বা সংস্কার–ভাবনার প্রতিনিধি। পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ইতিহাস ও ভাববস্তুর বারংবার পুনর্বিবেচনার তাঁরা অংশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের যে বদল ঘটে, তার সঙ্গে মিলিয়ে সেখানকার সারস্বত সমাজ এই মনীষীদের নতুন নতুন ভাষ্য হাজির করে, তা আত্মস্থ করে।
পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের ইতিহাস এর আশ্চর্য ব্যতিক্রম। এখানে ব্যক্তি নয়, জনতাই প্রধান। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং সবশেষে ২০২৪ সালই এখানে দ্রষ্টব্য। এসব ইতিহাস–মুহূর্তে ব্যক্তির বদলে জনতাই কর্তাশক্তি। বাংলাদেশের প্রতিটি উজ্জ্বলতম ইতিহাসপর্বে জনতা জেগে উঠেছে। তার চেয়েও বড় কথা, জনতার আন্দোলন রাষ্ট্র, সমাজ বা বৃহত্তর ব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। আর এসব আন্দোলনের প্রথম স্ফুরণ সব সময় ছাত্রদের মধ্যেই আমরা দেখতে পাব। তারাই হয়ে উঠেছে আন্দোলনগুলোর প্রথম চালক।
ছাত্রদের হাত ধরে জনতা জেগে উঠেছে, আর তাতে পাল্টে গেছে ইতিহাস। অথচ সেসব ঘটনা নিয়ে আমরা নিছক স্মৃতিকথা ও সাধারণ ইতিহাসই লিখেছি। বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস এবং পাল্টে যাওয়া বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে সেসব ইতিহাসপর্বের ভাববস্তুর পর্যালোচনা বলতে গেলে কখনোই করিনি। আমাদের ইতিহাসের ভাববস্তু তাই বারবার হাতছাড়া হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, ছাত্ররাই কেন রাষ্ট্রের প্রবল মুহূর্তে ঘটনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে?
পৃথিবী চলিষ্ণু। প্রবীণেরা যে পৃথিবীতে বেড়ে ওঠেন, পৃথিবী তার থেকেও এগিয়ে যেতে থাকে। জীবনের যে নতুন সম্পর্ক ও চাহিদা জেগে উঠতে থাকে, তরুণেরাই তার স্পন্দন অনুভব করে সবচেয়ে আগে। পুরোনো ব্যবস্থাকে ভেঙে না ফেললে সেই নতুনকে পাওয়া অসম্ভব। প্রবীণেরা পুরোনো পৃথিবীতে অভ্যস্ত; স্থির জীবনের প্রত্যাশী। তরুণেরা পিছুটানহীন, বেপরোয়া, নিজেদের জন্য নতুন পৃথিবীকে পাওয়ার তৃষ্ণায় দুঃসাহসী। পদে পদে নিষেধের যে বাধা, তার উদ্দেশে তারা বলতে পারে, ‘নিষেধাজ্ঞাই এখন নিষিদ্ধ’, যে আবেগে ছাত্ররা এমন কথা বলেছিল প্যারিসের আন্দোলনে।
ছাত্র আর জনতার সম্পর্কও চমকপ্রদ। যেকোনো ছাত্রই মা–বাবার ভবিষ্যৎ প্রত্যাশার মূর্ত প্রতীক। মা–বাবা ও ছাত্র–সন্তানের সম্পর্ক বিশুদ্ধ আবেগ আর স্বপ্নের। ছাত্র ও জনতার সম্পর্ক তারই এক প্রসারিত চিত্র মাত্র। কোনো ন্যায্য দাবিতে কিশোর–তরুণ ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়লে তার প্রতি জনতার সস্নেহ সমর্থন দেখা যায়, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যেমনটা আমরা দেখেছি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে এই সম্পর্কের আরেকটি মাত্রা বের করা সম্ভব। পাটচাষিদের উদয়াস্ত শ্রমের টাকায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যশ্রেণি একটা ভালো আকার পেতে শুরু করল। তাদের সন্ততিরাই পড়তে এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই ছাত্ররা যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করল, পুরান ঢাকার সরদার ও অধিবাসীরা প্রথমে তাতে সমর্থন দেননি। কিন্তু ছাত্রদের বুকে গুলি চালানোর পরে মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা পুরো সমর্থন নিয়ে ওদের পক্ষে চলে আসেন। সন্তানেরা ভুল করতে পারে, তাই বলে ওদের হত্যা করা হবে? এই ছাত্রদের ওপরই কি তাঁরা নিজেদের জীবন বিনিয়োগ করেননি?
স্বাধীনতার আগে–পরে এই ছাত্রদের ভাবাদর্শ ও বিন্যাসের পরিবর্তনও দেখার মতো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সাধারণভাবে সব ধরনের ছাত্রছাত্রীই অংশ নিয়েছিল। তবে বাম সমাজতান্ত্রিক ধারার ছাত্ররাই প্রত্যক্ষে–প্রচ্ছন্নে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল। তখন স্নায়ুযুদ্ধের কাল। যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া পুরোনো নথিতে এ নিয়ে তাদের সে সময়ের উদ্বেগ লক্ষ করার মতো। স্বাধীনতার আগপর্যন্ত—১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন বা ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানে—আন্দোলনের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিল বাম গণতান্ত্রিক ধারার ছাত্ররাই। তারা সম্পৃক্তও করতে পেরেছিল জনতাকে। ১৯৮০–র দশকের শেষে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ধসের পরে এই চিত্র পাল্টে যায়। বাম ধারা দেশে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের আন্দোলনে সরাসরি ভূমিকায় দেখা গেল মূলধারার রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলোকে।
এবারের চিত্র একেবারেই আলাদা। এবার মূলধারার ছাত্রসংগঠন সেভাবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তবে সংস্কৃতিযজ্ঞে লিপ্ত রাজনীতির অভিলাষী একদল ছাত্র এ আন্দোলনে নেপথ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের সফলতার পেছনে নানা কারণ ছিল। তাদের ভাষা তরুণদের আকর্ষণ করেছে, বয়ান নানা স্তর ও গোষ্ঠীর মানুষকে যুক্ত করেছে, কৌশল রাষ্ট্রের শক্তি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
যেকোনো অভ্যুত্থানেরই দুটি পর্ব থাকে। একটি পতনের; আরেকটি পত্তনের। প্রথমটি পুরোনোর বিদায়, পরেরটি নতুনের অভ্যুদয়। প্রথমটাই অসম্ভব কঠিন, দ্বিতীয়টা আরও। নতুনের অভ্যুদয় কীভাবে কতটা হবে কিংবা আদৌ হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে যে জনতার আবির্ভাব ঘটল, ভবিষ্যতে তা কেমন পরিপক্বতা দেখায়, তার ওপর।
তবে পত্তন বা গড়ে তোলার পর্বটি যেদিকেই গড়িয়ে যাক না কেন, ২০২৪ সালের এই আন্দোলনে পতনের পর্বটি যেভাবে সফল হলো, তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের অংশ হয়ে পড়েছে।
ছাত্রছাত্রীরা এই সফলতার বড় ভাগীদার। তাদের টুপি–খোলা অভিবাদন।