ডলার–সংকটে থাকা বাংলাদেশকে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। বেইজিংয়ের এই আগ্রহ প্রকাশের পর চীনকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে আলোচনা শুরু হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের বিল ইউয়ানে নেওয়া ঋণ দিয়ে পরিশোধ করতে আগ্রহী। চীনের সঙ্গে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রমে এখন মার্কিন মুদ্রা ডলার ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস এখন চীন। ডলার–সংকট মোকাবিলা এবং ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠেকাতে ইউয়ানে দেওয়া চীনের ঋণ বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন। চীন চাইছে ইউয়ানে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ বাণিজ্য–সহায়তা (ট্রেড ফ্যাসিলিটি) হিসেবে দিতে। চীনা মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ইউয়ানের বেশি।
তবে এ ধরনের ঋণের শর্ত সাধারণত কঠিন হওয়ায় বাংলাদেশ বাণিজ্য–সহায়তার পরিবর্তে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে আগ্রহী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনের আগ্রহের বিষয়টি নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। এরপর বাংলাদেশ এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কাছে প্রস্তাব দেবে।
চীনের কাছ থেকে ইউয়ানে ঋণ দেওয়ার আগ্রহ এমন সময় প্রকাশ করা হয়েছে, যখন বেইজিং তার মুদ্রা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং লেনদেনে আরও বেশি ব্যবহার করতে আগ্রহী। দেশটি ইতিমধ্যে বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ইউয়ানে আন্তর্জাতিক লেনদেন করছে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির খরচ ইউয়ানে মেটাচ্ছে চীন। আমদানি–রপ্তানিতে আরও বেশি করে ইউয়ান ব্যবহার করে নিজস্ব মুদ্রাকে ডলারের বিপরীতে একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই অর্থনীতি।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন বর্তমানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ এখন দুই হাজার কোটি ডলারের বেশি, যার প্রায় পুরোটা বাংলাদেশের আমদানি। অর্থাৎ চীন থেকে পণ্য আমদানি করতে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ ডলার খরচ করতে হচ্ছে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইউয়ান ব্যবহার করতে পারলে ডলার–সংকটের এই সময়ে বাংলাদেশের বড় পরিত্রাণ হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রথমে চীন থেকে ইউয়ানে ঋণ নেবে। তারপর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে সেই ইউয়ান পরিশোধ করা হবে। এখন চীন থেকে পণ্য আমদানি করলে ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ইউয়ানে আমদানি দায় মেটানো গেলে দেশ থেকে ডলার কম বের হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ধরে রাখতে সহায়তা করবে। গত দুই বছরে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে ২০২৩ সালের শুরুতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এখন তা ২ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ডলারের চাপ সামলে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য চীনের আমদানি ব্যয় ইউয়ানে মেটাতে এই ঋণ নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এই ঋণ কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা ঠিক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করতে শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ঋণ প্রস্তাব নিয়ে পর্যালোচনা
চীনের ঋণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন চলাকালে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলামের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর সাইডলাইন বৈঠক হয়। বৈঠক চলাকালে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বাণিজ্য–সহায়তা বাবদ ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান ঋণের প্রস্তাব দিতে অনুরোধ করেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের এই আগ্রহ প্রকাশের পর এ নিয়ে ঢাকায় আলোচনা শুরু হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্য–সহায়তা ঋণের প্রস্তাবটি নতুন ধরনের, তাই এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করতে ইআরডিকে অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত মাসে এ নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে ইআরডি। এতে সভাপতিত্ব করেন ইআরডির এশিয়া বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন।
সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি মেটাতে এই ঋণ ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি মত দেন, এই ঋণের সুদের হার কোনোভাবেই যেন ১ শতাংশের বেশি না হয় এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ যেন দীর্ঘ হয়। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঋণের সুদের ওপর কর মওকুফ করা হবে না।
সভায় অংশ নেওয়া সবাই একমত হন যে ঋণটি বাণিজ্য–সহায়তা হিসেবে গ্রহণ করা হলে তা বাণিজ্যিক ঋণে পরিণত হতে পারে। এতে উচ্চ সুদ ও ঋণ পরিশোধকাল কম হতে পারে, যা বিদেশি ঋণের দায়দেনা পরিস্থিতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দীর্ঘ মেয়াদে স্বল্প সুদের ঋণ নেওয়া যেতে পারে। তাই বাণিজ্য–সহায়তার পরিবর্তে বাজেট সহায়তা হিসেবে এই ঋণ ব্যবহার করা বেশি যুক্তিযুক্ত।
জানা গেছে, চীনের এই ঋণের বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনা, প্রক্রিয়াকরণ ও পরবর্তী ঋণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করবে। এ ছাড়া অর্থ বিভাগও ঋণের অভিঘাত পর্যালোচনা করবে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মতামত পাওয়ার পর ইআরডি প্রয়োজনীয় আলোচনা ও দর-কষাকষি কার্যক্রম শুরু করবে। জানা গেছে, আগামী জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে যাওয়ার কথা আছে। এর আগেই এই ঋণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দর-কষাকষি শেষ হতে পারে।
এর আগে গত জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুস সালামের সঙ্গে দেখা করে চীনা মুদ্রায় বাণিজ্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠক শেষে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, ডলারের সমস্যাটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতির কারণে ডলারের দাম ওঠানামা করছে। চীনসহ প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশই ডলার নিয়ে সমস্যায় ভুগছে।
বাণিজ্যঘাটতি ১৯০০ কোটি ডলার
চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি প্রতিবছরই বাড়ছে। সেই তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে না। ফলে বাণিজ্যঘাটতি বেড়েই চলেছে। গত এক দশকে বাণিজ্যঘাটতি তিন গুণের বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীন থেকে ৬৩২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে গেছে মাত্র ৪৬ কোটি ডলার পণ্য। বাণিজ্যঘাটতি ৫৮৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে ১ হাজার ৯৮১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, রপ্তানি ছিল ৬৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে, বাণিজ্যঘাটতি ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের বেশি।
বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ায় চীন চতুর্থ
দেশে চীনা ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়, এমন ৩২টি দেশ ও সংস্থার মধ্যে চীনের অবস্থান এখন চতুর্থ। চীনের ওপরে আছে বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ প্রতিবছর মোট যে ঋণ পায়, তার প্রায় ১০ শতাংশ দেয় চীন। বার্ষিক ঋণ ছাড়ে দুই বছর ধরে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে রয়েছে চীন। অর্থাৎ দেশটি টানা দুই বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ দিয়েছে।
চীন যত ঋণ দিয়েছে, তার মধ্যে গত চার বছরে দিয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। এই অর্থ চীনের দেওয়া মোট ঋণের ৪০ শতাংশের মতো। চীনা ঋণের সুদের হার অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংস্থা ও দেশের দেওয়া ঋণের সুদের হারের প্রায় সমান। কিন্তু মূল সমস্যা হলো ঋণ পরিশোধের সময় বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে প্রতিটি কিস্তিতে বেশি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিলে গ্রেস পিরিয়ড বাদে পরবর্তী ১০ বছরে ঋণ ফেরত দিতে হলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হয় গড়ে ১০ কোটি ডলার। আর একই পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নিলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হয় গড়ে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার বাড়াতে চাইছে চীন। নিজেদের মুদ্রার নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে বিশ্বে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে আগ্রহী দেশটি। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে এই বিপুল পরিমাণ ইউয়ান ঋণ দিতে চায় চীন।’ জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ইউয়ানে আমদানি ব্যয় পরিশোধ হলে ডলারের ওপরে চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু কী ধরনের শর্ত দেওয়া হচ্ছে, তার ওপর ঋণের কার্যকারিতা অনেকটা নির্ভর করবে। শুধু চীনের আমদানি ব্যয় মেটাতে এই ঋণ ব্যবহার করা হবে, নাকি অন্য কোনো দেশের পাওনা পরিশোধেও তা ব্যবহার করা যাবে, সেটা দেখতে হবে। আবার ঋণ পরিশোধ, সুদের হার—এসব বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে। সবকিছু অনুকূলে থাকলেই ঋণ নেওয়া যেতে পারে।