ঢাকার বায়তুল মোকাররমের ফুটওভার ব্রিজের নিচে একটি চায়ের দোকান রয়েছে। এ দোকানের চা পান করার জন্য প্রতিদিন ছুটে আসেন ওয়ারীর এক ভদ্রলোক। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এতদূর কেন আসেন চা পান করতে? তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, আমার এখন অভ্যাস হয়ে গেছে দূর-দূরান্তে গিয়ে চা পান করার। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন স্থানের চায়ের স্বাদ নিতেই তার এ চা ভ্রমণ। চায়ে চুমক দিয়ে তার দিন শুরু। আবার চায়ে চুমুক দিয়েই ঘুমের জগতে যাওয়া।এ দেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি একদিন তার এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে প্রথমেই চা দিতে বলেন। কিন্তু বন্ধু কোনো কিছু না খেয়ে চা পান করার ব্যাপারে নিষেধ করলে তিনি তার কোনো কথা শোনেননি। চা তার চাই-ই। কেন সবার আগে চা- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ওটা আমার কাছে এক ধরনের সঞ্জীবনী মনে হয়। চা ছাড়া লেখা তো দূরের কথা কোনো চিন্তাই মাথা থেকে আসে না।সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন কর্মীর মধ্যে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল চা বিষয়ে। বেশিরভাগ বলেছেন, দিন শুরু হয় চা পানের মধ্য দিয়ে। আবার কর্মক্ষেত্রে চা ছাড়া যেন কাজ শুরু হয় না। ভারতের কবি ও কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকায় এক মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সারা দিন আমার কোনো কিছু না খেলেও চলে, কিন্তু চা ছাড়া আমি কোনো কাজ করতে পারি না। লেখা শুরু করার আগে চা পান করা চাই। এ যেন এক অজানা নেশা। চা যত পান করি, তত যেন মাথাটা খুলে যায়।চা পান করেন না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ‘এক কাপ চা’। এটি প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার হলেও বোঝা যায়, চায়ের সঙ্গে এখন সবার বসবাস। এ যেন জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে চা কিন্তু শুধু পানীয় হিসেবে ব্যবহার হয় না। চা অনেক সময় দেশে বন্ধুত্ব তৈরিতেও সহায়তা করে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭৩ সালের একটি ঘটনা। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় আরবদের প্রতি সমর্থন ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে মিসরে চা পাঠিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ এখন চায়ের কাছে অভ্যাসের দাস হয়ে গেছে বললে ভুল হবে না। পানির পরেই চা বিশ্বের সবচেয়ে উপভোগ্য পানীয় হিসেবে প্রচলন রয়েছে। চায়ে এক ধরনের প্রশান্তিদায়ক স্বাদ রয়েছে। রয়েছে স্বাস্থ্যগুণও। ফলে চায়ের আবেদন কোনো দিন কমেনি। বরং তা বেড়েই চলেছে।যে চা নিয়ে এত কথা তার ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরোনো। খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগে চীনের ইউনান প্রদেশে এক ঔষধি পানীয় হিসেবে চা পানের শুরু। পরবর্তী সময়ে তা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে চা এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে চীন সারা বিশ্বে চায়ের জন্মস্থান হিসেবে সুপরিচিত। এখনও চীনে চায়ের উৎপাদন বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।ইতিহাস বলে উপমহাদেশে চা শিল্প অনেক পুরোনো। তবে ১৮০০ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতবর্ষের আসাম ও আশপাশের এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয় ১৮২৮ সালে। চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪০ সালে। তবে এ নিয়ে কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। আর মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ অলংকরণ করেন। একই সঙ্গে তিনি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও শ্রীমঙ্গলে চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২তম। বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে থাকা দেশগুলো হলো- তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, জাপান ও থাইল্যান্ড। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে রেকর্ড ১০২ দশমিক ৯২ মিলিয়ন কেজি (১ লাখ টনের কিছু বেশি) চা উৎপাদন হয়েছে। এক মিলিয়ন কেজির কিছুটা বেশি পরিমাণ চা রফতানি করা হয়েছে। রফতানিকৃত চায়ের মূল্য ২৭২ মিলিয়ন টাকার চেয়ে সামান্য বেশি। দেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৩০ লাখ কেজি।স্বাধীনতার পর বাংলাদেশটি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সুপারিশে ১৯৭৫ সালে বাগান মালিকদের কাছে আবার হস্তান্তর করা হয়। ১৯৭৩ সালে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট গঠন করা হয়। চা শিল্পে জাতির পিতাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০২০ সালের ২০ জুলাই মন্ত্রিসভা বৈঠকে ৪ জুনকে জাতীয় চা দিবস হিসেবে পালনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২১ সাল থেকে ৪ জুন জাতীয় চা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে ৪ জুন প্রথমবারের মতো চা শিল্পে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় চা পুরস্কার দেওয়া হয়।চা বোর্ডের সূত্র অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৮টি। ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি পথনকশা তৈরি করেছে।আগামী ২০২৪-২৭ অর্থবছরের নতুন রফতানি নীতিতে চা শিল্পের জন্য ১৩টি সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, চা বাগানের আওতাধীন অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা হবে। রুগ্ন চা বাগানের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদেশে চায়ের বাজার সম্প্রসারণ করা হবে। প্যাকেট চা রফতানিকে উৎসাহিত করা হবে।সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চা পাতা দিয়ে রূপচর্চা করা যায়। ত্বকের জন্য, চুলের জন্য এর ব্যবহার অতুলনীয়। চা শুধু বাংলাদেশেই নয়, চীন থেকে শুরু করে জাপান, যুক্তরাজ্য, মরক্কো, তুরস্ক, ভারতীয় উপমহাদেশে চা এখন জাতীয় পানীয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ^ব্যাপী চা জনপ্রিয় করে তোলার জন্য যুক্তরাজ্যের অনেক ভূমিকা রয়েছে। মরক্কোর পুদিনা চা এখন দেশ-বিদেশে বেশ জনপ্রিয়। আর চায়ের জন্মভূমি চীনে যে কত ধরনের চা রয়েছে তার কোনো হিসাব নেই।