আড়াই মাসের শিশুসন্তানকে দেখে বরিশাল থেকে কর্মস্থলে ফিরছিলেন নয়ন মৃধা (৩৬)। গাজীপুরের টঙ্গীতে মার্স স্টিচ লিমিটেড নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানার অফিস সহকারী ছিলেন তিনি। গত ১০ জানুয়ারি ভোর পৌনে পাঁচটায় টঙ্গী পৌঁছান নয়ন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের হোসেন মার্কেট এলাকায় বাস থেকে নেমেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। মুঠোফোন ও নগদ টাকার সঙ্গে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন তিনি।
এ ঘটনায় নয়ন মৃধার চাচাতো ভাই ছিদ্দিকুর রহমান বাদী হয়ে ওই দিনই টঙ্গী পশ্চিম থানায় হত্যা মামলা করেন। তিনি জানান, নয়ন যেখানে বাস থেকে নেমেছিলেন, জায়গাটি ছিল নির্জন, অন্ধকারাচ্ছন্ন। এর মধ্যেই একটি মোটরসাইকেলে এসে দুই ছিনতাইকারী তাঁর ব্যাগ, মুঠোফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা নয়নকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান নয়ন। ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘নয়ন মৃধারা দুই ভাই। নয়নই বড়। তাঁর তিন ছেলে। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবার এখন পথে বসার দশা।’
শুধু নয়ন মৃধা নন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছিনতাইয়ের এমন ঘটনা। কখনো রাতের অন্ধকারে পথ আটকে, কখনোবা থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী-পথচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র। কেউ বাধা দিলে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হওয়াসহ প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেককে।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে শারীরিক জখম নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই ছিনতাইয়ের শিকার। গত এক বছরে ছিনতাইকারীর হামলায় আহত হয়েছেন এমন রোগী পেয়েছি ৯৪ জন। এসব রোগীরা আসেন রাতে।’
সড়কটি ঘিরে রয়েছে গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পূর্ব, পশ্চিম, গাছা, বাসন ও সদর থানা। গত এক বছরে এসব থানা এলাকায় কয়টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বা অভিযোগ পড়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি পুলিশ। তবে থানার ডিউটি অফিসাররা জানান, প্রতি মাসে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘটা ছয় থেকে সাতটি ছিনতাইয়ের লিখিত অভিযোগ পান তাঁরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়ে টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানায়।
১১ ছিনতাই স্পট
দুই সপ্তাহ ধরে সড়কটি ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ১১টি ছিনতাই স্পট বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার কথা জানা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো আবদুল্লাহপুর বেইলি সেতুর দক্ষিণপাড়, সান্দারপাড়া রাস্তার মাথা, হোন্ডা গলি, শহীদ আহসান উল্লা মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের পেছনে, মিলগেট, ন্যাশনাল টিউবস রোডের মাথা, সফিউদ্দিন রোডের মাথা, হোসেন মার্কেটের কাঠপট্টি, গাজীপুরা বাঁশপট্টি, তারগাছ ও চান্দনা চৌরাস্তায় ময়মনসিংহ বাস কাউন্টার এলাকা।
বাসিন্দারা জানান, সন্ধ্যার পরপরই এসব এলাকায় ঘোরাঘুরি করে অল্প বয়সী কিছু ছেলে। গভীর রাতে কাউকে সড়কে একা পেলে চাকুর ভয় দেখিয়ে বা যানজটে বাসের জানালায় থাবা দিয়ে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। এ সময় কেউ বাধা দিলেই ছুরিকাঘাত করে আহত করে তারা।
টঙ্গী বাজার এলাকায় সেনাকল্যাণ ভবনসংলগ্ন এনভায়রো ফিলিং স্টেশনে কাজ করেন মো. তুহিন। তিনি বলেন, ‘ছয় মাস আগে রাত একটার দিকে হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের স্টেশনে এসে কাঁদতে থাকেন। তাঁর হাত, পা কাটা, রক্ত ঝরছিল। পরে আমার কাছে থাকা একটি ব্যান্ডেজ দিয়ে তাঁর হাত-পা বেঁধে দিই। মাঝেমধ্যেই আমরা এমন ঘটনা পাই।’
দল বেঁধে চলেন পোশাকশ্রমিকেরা
গত ২৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কটি বেশ নির্জন। যানবাহন কম। চারপাশ অন্ধকার। এর মধ্যেই কারখানা ছুটি শেষে বাসায় ফিরছেন কিছু শ্রমিক। তাঁদের কারও হাতে টর্চলাইট, কেউবা হাঁটছেন মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে। ছিনতাই বা যেকোনো বিপদ এড়াতে হাঁটছেন দল বেঁধে। গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কথা হয় শ্রমিক লুৎফা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক মাস আগে রাতে বাসায় ফেরার সময় গাজীপুরা বাঁশপট্টি এলাকায় এক ছিনতাইকারী চাকু ধইরা মোবাইল নিয়া যায়।’
টঙ্গীতে অবস্থিত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুর কার্যালয়ের তথ্যমতে, গাজীপুর মহানগর এলাকায় নিবন্ধিত পোশাক কারখানা আছে ৪৯২টি। এসব কারখানার অধিকাংশই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসংলগ্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কারখানা ছুটি হয় রাত ১০টা, ১১টা, কখনোবা ১২টায়। এ কারণে গভীর রাতে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় পোশাকশ্রমিকদের।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই শ্রমিকেরা আমাদের কাছে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে জিনিসপত্র হারানোর কথা বলেন। এই প্রবণতা বেশি থাকে প্রতি মাসের ৭ তারিখের পর। কারণ এ সময় শ্রমিকেরা বেতন পান।’
মামলা করে লাভ হয় না
গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতায় যাচ্ছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার দরিদ্র কৃষক আমিনুল ইসলাম। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় হঠাৎ ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। বাসের জানালা দিয়ে চাকুর ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট, চিকিৎসার নগদ ৬০ হাজার টাকা, ৮ হাজার ভারতীয় রুপি, ২টি মুঠোফোনসহ মেডিকেল রিপোর্ট। এ ঘটনায় পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারি টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন আমিনুল। কিন্তু প্রায় এক বছরেও উদ্ধার হয়নি ছিনতাই হওয়া মালামাল। গত ২৮ জানুয়ারি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আমিনুলের ছোট ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ছিনতাইয়ের পর আমরা বহুবার টঙ্গী পূর্ব থানায় যোগাযোগ করেছি, মালামালগুলো উদ্ধারের অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা কোনো গুরুত্বই দেয়নি।’
এদিকে ছিনতাইকারীর হাতে নয়ন মৃধা খুনের ঘটনার দুই দিন পর ১২ জানুয়ারি দুই আসামির মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও আরেকজন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও টঙ্গী পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাহিদুল ইসলাম বলেন, অপর ব্যক্তিকে ধরতে পারলে ছিনতাই হওয়া মালামালও উদ্ধার করা যাবে।
জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম গত শনিবার বলেন, ‘ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য আছে, এটা সত্য। এর বড় কারণ টঙ্গী এলাকার বিভিন্ন বস্তি। এসব বস্তির কারণে ছিনতাইকারীর সংখ্যাটা বেশি।’ তা ছাড়া পুলিশের লোকবল–সংকট থাকার কথাও জানালেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মহাসড়কটিতে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) গাজীপুর জেলা শাখার সদস্য ও গাজীপুর ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, মুঠোফোন, টাকা, গয়না ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা পুলিশের কাছে গুরুত্ব পায় না। বেশির ভাগ সময় অভিযোগও পড়ে না বা মালামালও উদ্ধার হয় না।