Skip to content

ক্যাশিয়ার থেকে কোটিপতি

    ক্যাশিয়ার থেকে কোটিপতি prothomasha.com

    বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইমরুল কায়েস। অবৈধভাবে নার্সিং কলেজ অনুমোদন দিয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। কেউ তাঁর আত্মীয় হলেই পেয়ে যান চাকরি। আবার পাস না করা শিক্ষার্থীকে নার্সিংয়ে ভর্তি, জাল সনদ প্রদান, কোচিং বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইমরুল পড়াশোনা শেষ করে ২০০৪ সালে ক্যাশিয়ার হিসেবে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি ও ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যুক্ত হন। কাজের সুবাদে তাঁর পরিচয় হয় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকের ছেলে মো. জিয়াউল হকের সঙ্গে। এর পর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৯ সালে মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে ইমরুলের স্ত্রী তানজিনা খান পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তানজিনার নামেই রয়েছে আটটি নার্সিং কলেজ। এই ব্যবসা দিয়েই স্ত্রীর নামে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি।

    তবে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ১৭ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারী তাঁর এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার বিষয়ে অনুমতি দিতে পারবেন না।’ তবে এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন ইমরুলের স্ত্রী। বর্তমানে তাঁর মূল বাণিজ্য টাকার বিনিময়ে নার্সিং কলেজ অনুমোদন দেওয়া।

    সম্প্রতি প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম মডার্ন নার্সিং কলেজের অনুমোদন করে দেওয়ার জন্য সৈয়দ জাহেদ হোসাইন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করেন ইমরুল। ওই ব্যক্তি ইমরুলের অফিসে এসে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে যান। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তারসহ আরও দু’জন চট্টগ্রাম মডার্ন নার্সিং কলেজ পরিদর্শনে যান। তবে ল্যাবের রুম ছোট হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল। এর পর জাহেদকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন ইমরুল। একাধিকবার ফোন দিলেও সাড়া দেন না। বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন ওই ব্যক্তি। তাঁর অভিযোগ আমলে নিয়ে ৮ মার্চ ইমরুল কায়েসকে সাময়িক বহিষ্কার করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

    নিয়ম অনুযায়ী এই বহিষ্কার আদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার কথা। তবে অনুষদের সচিব ডা. মো. জাহিদুর রহমানের সঙ্গে ইমরুলের বিশেষ সম্পর্ক থাকায় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেননি বলে অভিযোগ ওঠে। ১৯ মার্চ স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

    শুধু সৈয়দ জাহেদের কাছ থেকেই নন, এমন আরও আটজনের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নার্সিং প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন ইমরুল। এর আগেও বাংলাদেশ প্রাইভেট আইএইচটি ও ম্যাটস প্রতিষ্ঠানের মালিক সমিতি এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে। সেই অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন ডা. জাহিদ। ইমরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করেন তিনি। গুরুদণ্ডের পরিবর্তে লঘুদণ্ড প্রদান করে কমিটি; কিন্তু সেই দণ্ডও কার্যকর হয়নি। এর পর মালিক সমিতি হাইকোর্টে ইমরুলের বিরুদ্ধে মামলা করে, যা এখনও চলমান।

    অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো উদ্যোক্তা বা ছাত্রছাত্রী প্রাতিষ্ঠানিক বা একাডেমিক কোনো কাজে অনুষদে গেলে এখানে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্য হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ঘুষ প্রদান করতে হয়। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই সম্ভব হয় না। এই সিন্ডিকেটের কাছে অনুষদের বাকি সব কর্মকর্তা-কর্মচারী অসহায়। অনুষদ থেকে সার্টিফিকেট, মার্কশিট, নাম সংশোধন ও রেজিস্ট্রেশন-সংক্রান্ত অন্য সব কাজের জন্য ঘুষ দিতে হয় তাদের।

    সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুষদের সচিব ডা. জাহিদের মাধ্যমে ইমরুল কায়েসের স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ট্রমা ম্যাটস ও শ্যামলী ম্যাটসে কর্মরত তাঁর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। অনুষদের হিসাবরক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও ডেসপাচ রাইটার নাদিরা বেগম শ্যামলী ম্যাটসে এবং ক্যাশিয়ার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ট্রমা ম্যাটসে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া কম্পিউটার অপারেটর মো. শাকিল হোসেন ইমরুল কায়েসের খালাতো ভাই, বিএমডিসির হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ফুপাতো ভাই এবং নার্সিং কাউন্সিলে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শায়লা আক্তার তাঁর ফুপাতো বোন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিয়োগ পাওয়া ডা. আফরিন জামান সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে ট্রমা উইমেন্সের কর্মকর্তা ছিলেন। এমএলএসএস মোহাম্মদ রাসেল মিয়া ইমরুলের প্রতিবেশী। এসব নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ ও টাকা বৈধ করতে সামাজিক সংগঠন উৎসর্গ ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন এ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এই ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে অবৈধ আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে।

    এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অনুষদের সচিব ডা. জাহিদুর রহমান সমকালকে বলেন, তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। যে অভিযোগের কথা বলছেন, এই অভিযোগের তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি। তদন্তের বাইরে কিছু বলতে চাই না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইমরুল কায়েস বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। অভিযোগের বিষয়ে ইমরুলের স্ত্রী তানজিনা খানকে সোমবার বিকেলে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, ইফতারের পর এ বিষয়ে কথা বলব। তবে ইফতারের পর একাধিকবার ফোন দিলেও সাড়া দেননি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর বলেন, ২৭ মার্চ তদন্তের জন্য অভিযোগকারীকে ডাকা হয়েছে। দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।