অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরের ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন ব্যবসায়ী সৈয়দ মুহাম্মদ তারেক। আশা ছিল, ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করবেন। বড় মেয়ে মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ভেবেছিলেন, ছোট ছেলেটাও বোনের পথ অনুসরণ করে নিজেকে গড়ে তুলবেন। কিন্তু কলেজপড়ুয়া আসকার বিন তারেক (১৯) জড়িয়ে পড়েছিলেন কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে। অনেক বুঝিয়েছিলেন তাঁরা, শোনেননি। দুই বছর আগে ছুরিকাঘাতে খুন হন আসকার। ঘটনার দুই মাস পর শহর ছেড়ে একেবারে লোহাগাড়ার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান সৈয়দ তারেক।
ব্যবসায়ী সৈয়দ মুহাম্মদ তারেক চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার এনায়েত বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকেছেন ২০ বছর। সন্তানদের লেখাপড়ার কথা ভেবেই গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা ছেড়ে শহরে আসা তাঁর। কিন্তু ছেলে আসকার ছুরিকাঘাতে মারা যাওয়ার পর মন ভেঙে যায় ব্যবসায়ী তারেকের। তিনি বলেন, ‘এ শহরে ছেলেকে হারিয়েছি। তাই শহর ছেড়ে আবার গ্রামে চলে গেছি।’ আসকারের বাবা সৈয়দ মুহাম্মদ তারেক ২৩ মার্চ বলেন, ‘শতচেষ্টা করেও ছেলেকে ধরে রাখতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেছি। ছেলে অহেতুক আড্ডা, আজেবাজে বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছিল। তাকে বোঝানো হতো, এগুলো একদিন বিপদ হতে পারে। কিন্তু সে কারও কথা শুনত না।’
সৈয়দ মুহাম্মদ তারেক পোশাক কারখানায় মালামাল সরবরাহের ব্যবসা করেন। এখন গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে ব্যবসার কাজ সারেন। এতে তাঁর অসুবিধা হলেও শহরে থাকতে তিনি নারাজ। নগরের চেরাগী মোড় (যেখানে আসকার খুন হয়েছিলেন), জামালখান, এনায়েত বাজারসহ শহরের বিভিন্ন জায়গার নাম শুনলেই তাঁর ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। এখনো প্রতিনিয়ত ছেলের কথা মনে করে কাঁদেন তিনি।
আসকারের মা শহীদা বেগম আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। আর যেন কোনো মা-বাবার বুক খালি না হয়, সে প্রত্যাশা জানিয়েছেন তিনি। শহীদা বেগম বলেন, ‘ছেলেকে ছাড়া কীভাবে বেঁচে আছি, জানি না।’ ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল নগরের জামালখান চেরাগী মোড় এলাকায় কলেজছাত্র আসকার বিন তারেককে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। এ ঘটনায় বাবার করা মামলায় তদন্ত শেষে পুলিশ গত বছরের অক্টোবরে ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পাঁচ আসামি আদালতে আসকার খুনের বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, আসামিরা বলেছেন, মোহনের ছুরিকাঘাতে আসকারের মৃত্যু হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ববিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। আসামিদের মধ্যে তিনজন কিশোর। বাকি সাতজনের বয়স ১৯ থেকে ২২ বছর। আসামিরা সবাই ‘ফাইভ স্টার গ্রুপের’ সদস্য। শুরুতে পাঁচজন থাকায় ফাইভ স্টার নাম দেওয়া হয়। বর্তমানে সদস্যসংখ্যা অর্ধশত। এলাকার স্কুল-কলেজগামী ছেলেদের ‘ক্ষমতার দাপট’ দেখানোর লোভ দেখিয়ে নিজেদের দলে নিয়ে আসে তারা।
আসকার হত্যা মামলার আসামি শচীন দাশ, প্রিয়ম বিশ্বাস, সৌভিক পাল, নিলয় দত্তসহ আসামিরা সবাই নগর ছাত্রলীগের সদস্য পরিচয় দেওয়া সৈকত দাশের অনুসারী। আর সৈকত স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। জানতে চাইলে জামালখানের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ বলেন, ‘আমার কাছে অনেকেই আসে। তাই কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। আমি নিজেও কিশোর গ্যাং-বিরোধী। এসব বন্ধের জন্য কাজ করছি। তরুণদের নানাভাবে সচেতন করছি।’
চলতি বছরের শুরুতে নগর পুলিশের করা এক জরিপে উঠে আসে, নগরে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি গড়ে মাত্র ৪৬ শতাংশ। অনুপস্থিত থাকা ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ ছাত্র। এই ছাত্রদের অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের অগোচরে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের ‘বড় ভাই’দের প্ররোচনায় জড়াচ্ছে অপরাধে। শুরুতে তারা হিরোইজম (বীরত্ব) দেখানোর জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। পরে তা থেকে বের হতে পারে না।
নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যাতে শিক্ষার্থীরা অপরাধে জড়াতে না পারে, সে জন্য শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণকারী যে রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরে ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। পুলিশের হিসাবে নগরজুড়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ে পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন ‘বড় ভাই’। গত ৬ বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় না হওয়ায় কিশোরেরা আদর্শহীনভাবে বেড়ে উঠছে। এমনটা মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পথশিশু-কিশোর যারা আছে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।