ভরা মজলিসে স্টেভিন জন নামটা বললে হয়তো বেশির ভাগ লোকই চিনবে না। তবে ‘ব্লিপি’ নামটা বললে কেবল কথা বলতে শেখা শিশুদের অনেকেই আপনার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাবে; শুধু ছোটরা নয়, তাদের মা–বাবারাও। কারণ, ইউটিউবে এই ব্লিপিই বুঁদ করে রেখেছে পৃথিবীর নানান প্রান্তের শিশুদের। জেনে নিন তাঁর সাফল্যের কথা এবং নবীন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য তাঁর পরামর্শগুলো—চমৎকার সব শিশুতোষ ভিডিও বানান স্টেভিন জন। তাঁর চ্যানেলের নাম ‘ব্লিপি – এডুকেশনাল ভিডিওস ফর কিডস’। চ্যানেলটির মূল সঞ্চালক স্টেভিন নিজে, ফলে তাঁর নামও হয়ে গেছে ব্লিপি।
নানান বিষয়ে ভিডিও বানান স্টেভিন। আপেল, চেরি, রাস্পবেরির মতো ফলগুলো কীভাবে খেত থেকে বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে সুপারশপে বিক্রি হয়, কীভাবে দমকল বাহিনীর ট্রাক কীভাবে আগুন নেভায়, আবর্জনার ট্রাক কীভাবে কাজ করে—এমন ভিডিও শুধু ছোটরাই নয়, বড়রাও উপভোগ করেন। ব্লিপি কখনো চলে যান ইনডোর প্লেগ্রাউন্ডে, মেতে ওঠেন শিশুদের মতো খেলাধুলায়। কখনো চকলেট ফ্যাক্টরিতে গিয়ে দেখান, কীভাবে চকলেট তৈরি হয়। কখনো–বা চলে যান কোনো কৃষকের বিশাল খামারে; মাটি থেকে তুলে দেখান গাজর
।
এ ছাড়া হাতে–কলমে করে দেখান বিজ্ঞানের নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা। কোন বস্তু পানিতে ভাসে, কোনটা ডুবে যায়—শিশুরা সেসব শিখতে পারে ঘরে বসেই। মাঝেমধ্যে খুদে দর্শককে ঘুরে দেখান বড় বড় বিজ্ঞান জাদুঘর। ব্লিপি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, তবে কখনো কখনো নতুন দেশেও যান ভিডিও বানানোর জন্য। নতুন দেশের মানুষ আর পরিবেশের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেন।শিশুদের জন্য এমন সব ভিডিও বানিয়ে স্টেভিন এখন বছরে আয় করেন ২৫ মিলিয়ন ডলার। তাঁর মোট সম্পদ ১৪০ মিলিয়ন ডলার।
জীবনের শুরুতে
স্টেভিন জনের জন্ম ১৯৮৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলেন লিমুজিনচালক আর ফাইটার পাইলট। হাইস্কুল পাস করার পর যোগ দেন মার্কিন বিমানবাহিনীতে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। বিমানবাহিনী থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর চাকরি করেছেন বিপণন পরামর্শক হিসেবে। পাশাপাশি টুকটাক সিনেমা ও বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজেও যুক্ত ছিলেন।
যেভাবে ইউটিউবে এলেন
২০১১ সালে স্টেভিন একদিন দেখলেন, তাঁর ভাগনে ইউটিউবে মনোযোগ দিয়ে ভিডিও দেখছে। ভাগনের প্লে লিস্ট ঘেঁটে দেখলেন স্টেভিন। তাঁর ভাষ্যে, ‘বেশির ভাগ ভিডিওই ছিল নিম্নমানের।’ সেদিনই স্টেভিন ঠিক করেন, শিশুদের জন্য একটি শিক্ষামূলক ও আনন্দদায়ক ইউটিউব চ্যানেল চালু করবেন।স্টেভিন প্রথমে চিন্তা করলেন, ভিডিও লাইভে আসা বেশি কঠিন নাকি অ্যানিমেশন বেশি কঠিন? শেষ পর্যন্ত নিজেই ক্যামেরার সামনে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সে জন্য একটা মজাদার চরিত্র চাই, যে বয়সে বড় হলেও শিশুদের মতো হাসবে, খেলবে। প্রথমে চরিত্রটির নাম ঠিক করতে বসলেন স্টেভিন। এমন একটি নাম দরকার ছিল, যাতে একটি বর্ণ কয়েকবার ব্যবহৃত হবে; শিশুরা যাতে নামটা মনে রাখতে পারে।
প্রায় ৭০০–৮০০টি নাম নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেন স্টেভিন। কপিরাইট, ওয়েবসাইট ডোমেইনের সহজলভ্যতা ইত্যাদি নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি শেষে চরিত্রটির নাম রাখলেন ‘ব্লিপি’। এবার ভাবতে বসলেন ব্লিপির পোশাক নিয়ে। মাথায় নীল-কমলার মিশেলে দুইরঙা ক্যাপ, পরনে নীল শার্ট আর জিনস, কমলা বো-টাই আর সাসপেন্ডার। পায়ের জুতাতেও নীল-কমলা। হয়ে গেল ব্লিপির কস্টিউম ডিজাইন।
যাত্রা শুরুর গল্প
শুরু হলো ভিডিও তৈরির কাজ। প্রথমে স্টেভিন নিজেই ছিলেন একাধারে ক্যামেরাম্যান, অভিনেতা ও ভিডিও সম্পাদক। এমনকি প্রথম দিকে মাথার টুপিটাও ছিল তাঁর মায়ের নিজের হাতে সেলাই করা। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ইউটিউবে প্রথম ভিডিও প্রকাশ করেন স্টেভিন। প্রথম দিকে ভিডিওগুলোয় খুব একটা ভিউ ছিল না। কিন্তু কাজ চালিয়ে গেছেন নিজের মতো করে। এভাবেই একসময় তাঁর ভিডিওগুলো পেতে থাকে হাজার হাজার ভিউ। এক বছরের মধ্যে ব্লিপির ভিডিওগুলো পায় ১ মিলিয়ন ভিউ।
শুধুই এগিয়ে যাওয়া
ব্লিপির মূল চ্যানেল ‘ব্লিপি – এডুকেশনাল ভিডিওস ফর কিডস’–এর সাবস্ক্রাইবার এখন ১৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন। স্প্যানিশ, ফরাসি, জার্মান, আরবি, জাপানি, হিব্রু, সুইডিশ, ড্যানিশ, ওয়েলশ, পর্তুগিজ, ইতালীয়, পোলিশসহ আরও কিছু ভাষায় ডাবিং করে ভিডিওগুলো দেখানোর জন্য আছে ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল। ব্লিপির আছে নিজস্ব খেলনার ব্র্যান্ড ‘ব্লিপি টয়েজ’। চরিত্রটির টুপিসহ বিভিন্ন পোশাক শিশুদের খুব প্রিয়। এ ছাড়া আছে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ।
করোনা মহামারির সময়ই ব্লিপির জনপ্রিয়তা ও ব্যবসা এগিয়েছে তরতর করে। জনপ্রিয়তা অবশ্য এর আগে থেকেই পেয়েছেন। ২০২০ সালের শেষে ফোর্বস ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী ইউটিউবারদের তালিকায় ব্লিপির নাম উঠে আসে। তখন তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ১৭ মিলিয়ন ডলার, ভিউ ছিল ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন এবং সব চ্যানেল মিলিয়ে সাবস্ক্রাইবার ছিল ২৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন। ২০২৪ সালের শুরুতে স্টেভিনের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪০ মিলিয়ন ডলারে; বার্ষিক আয় ২৫ মিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির ফ্লোরিডায় বিশাল এক বাড়িতে থাকেন স্টেভিন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় আরও ৯টি বাড়ি আছে তাঁর, সবই ভাড়া দিয়েছেন। মালিকানায় আছে ১০টির বেশি বিলাসবহুল গাড়ি।২০২২ সালে স্টেভিন ছেলের বাবা হয়েছেন। একই সঙ্গে নিয়মিত কনটেন্ট তৈরি এবং সন্তান লালন–পালন মোটেও সহজ কাজ নয়। তাই ব্লিপির চরিত্রে ক্যামেরার সামনে কাজ করছেন ‘আরেক ব্লিপি’ ক্লেটন গ্রিম। যদিও দর্শক এখনো ‘আসল ব্লিপি’কে দেখার জন্যই মুখিয়ে আছেন।
সাফল্যের নেপথ্যে
শুধু উন্নত মানের কনটেন্ট তৈরিই যথেষ্ট নয় বলে বিশ্বাস করেন স্টেভিন। ভালো কনটেন্ট তৈরি করলেও যদি কেউ না দেখে, তাহলে লাভ কী? ভালো কনটেন্ট তৈরির পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয়ের ওপর তিনি জোর দেন। যাঁরা ভবিষ্যতে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হতে চান, তাঁদের এসব বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন—
১. নির্বাচিত প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদমের দিকে মনোযোগ দিন
স্টেভিন কনটেন্ট বানাতে শুরু করেছিলেন ইউটিউবের জন্য। ইউটিউবে এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্টেভিন আগে থেকেই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে এসইও সম্পর্কে খুব ভালো জানতেন। এই কারণেই ব্লিপির ভিডিওগুলোর টাইটেলের সঙ্গে বর্ণনামূলক কিছু শব্দ সব সময় থাকে। যেমন—Blippi’s Science Slime Challenge! 1 Hour of Blippi Episodes for Kids.
২. টার্গেট অডিয়েন্স কারা, তা জানুন, মতামত নিন
ব্লিপির টার্গেট অডিয়েন্স বা উদ্দিষ্ট ভোক্তা হলো ২-৬ বছরের শিশুরা। কিন্তু ব্লিপিকে শিশুদের অভিভাবকদের নিয়েও ভাবতে হয়েছে। কারণ, শিশুরা যখন ব্লিপির ভিডিও বেশি বেশি দেখবে, অভিভাবকদেরও তা সহ্য করতে হবে। তাই স্টেভিন তাঁর ইউটিউব ক্যারিয়ারের প্রথম বছরে মা-বাবাদের মতামত নিতে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। তাঁদের মতামতগুলোর ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছেন ‘ব্লিপি’ চরিত্রটি।
৩. ব্র্যান্ডিংয়ে লজ্জার কিছু নেই
ব্লিপির ভিডিওগুলোর একটি ট্রেডমার্ক আছে। প্রতিটি ভিডিওর শেষেই ব্লিপি চরিত্রটি নিজের নাম বানান করে বলে, ‘বি এল আই পি পি আই—ব্লিপি’। শিশুদের আকৃষ্ট করতে ও তাদের মাথায় ব্লিপি নামটি গেঁথে দিতে এটি বেশ ভালো একটি পদ্ধতি বলে মনে করেন স্টেভিন।
শিশুদের জন্য উন্নত মানের কনটেন্ট তৈরির লক্ষ্য নিয়ে একাই ইউটিউব চ্যানেল খুলে কাজ শুরু করেছিলেন স্টেভিন জন। পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তার জোরে ‘ব্লিপি’ আজ পরিণত হয়েছে বড় এক ব্র্যান্ডে। সব মিলিয়ে স্টেভিন জন এখন শিশুদের প্রিয় শিক্ষক ও বন্ধু হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।