কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? তাতে কী? চকলেটের মতো আমকড়ালি আকারের একটা আমসত্ত্ব মুখে দেন। দেখবেন, ক্লান্তি ঘুচে গেছে। কারণ, মিষ্টি আমসত্ত্বে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ রয়েছে। এটি শক্তিবর্ধক হিসেবে শরীরে এনার্জি এনে দেয়। একই সঙ্গে এটি একটি মুখরোচকও বটে।
কবিতায়ও আছে আমসত্ত্বের গুণগান। যেমন ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’ কবিতার এ কথাগুলো এখন দেখা যায় বাজারে বিক্রি হওয়া একটি আমসত্ত্বের মোড়কে। এই আমসত্ত্ব তৈরি করেন চট্টগ্রামের ৩৫ জন নারী। এই নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই ব্যবসায়ী মঈনুল আনোয়ার। তাঁর উদ্যোগের ফলে নারীদের বাড়তি আয়ের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। এর আগে তিনি মধু, সরিষার তেল, খেজুরের গুড়, কালিজিরার তেল নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম আলওয়ান।
বাংলাদেশের পাঁচটি আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আম বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে পছন্দ করে। কিন্তু আমের মৌসুম অল্প দিনের। আলওয়ানের আমসত্ত্বের মেয়াদ এক বছর থাকে।পাকা আমের নিংড়ানো রস বা পাল্প দিয়ে আমসত্ত্ব বানানো হয়। গ্রামে প্রাচীন পদ্ধতিতেই আমসত্ত্ব তৈরি করা হয়। প্রথমে আমের খোসা ছিলে আঁটি থেকে রস নিংড়ে লাকড়ির চুলায় জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়, পরে তা রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় আমসত্ত্ব।
আমসত্ত্ব এ দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাদ্য। অথচ এটি বাজারে সেভাবে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বাজারে প্রচুর পরিমাণে কেমিক্যাল ও কালার (রাসায়নিক ও রং) মেশানো বিদেশি নানা ধরনের ‘কালারড ড্রাই ফ্রুটস’ বিক্রি হয়, যেগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এ রকম চিন্তা থেকেই মঈনুল আনোয়ার আমসত্ত্বকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তিনি জানান, ১০০ বছর ধরে আমের আমসত্ত্ব আয়তাকার, বর্গাকার ও বৃত্তাকার আকৃতিতে তৈরি হয়ে আসছে। সে জন্য তিনি এটাকে আমের আকার দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর নাম দিয়েছেন আমের খাঁচা। প্লাস্টিকের এই মোড়কের গায়ে আমের পরিচয়সহ বিভিন্ন গুণাগুণের কথা লেখা রয়েছে। যেমন ‘ল্যাংড়া আমের মোড়কে লেখা রয়েছে দুধ মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চাদের ক্যান্ডি/চকলেটের পরিবর্তে খাওয়ানো যাবে। ঈষদুষ্ণ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে দ্রুত শরীরে শক্তি পাওয়া যাবে। যাঁদের প্রদাহজনিত সমস্যা আছে, যাঁরা দুর্বল বিপাকজনিত সমস্যায় ভুগছেন কিংবা চিকিৎসক যদি দুধ ও আমসত্ত্ব একসঙ্গে খেতে নিষেধ করেন, তবে এড়িয়ে যান।’
আশ্বিনা আমের আমসত্ত্বের মোড়কে মেয়াদসহ লেখা রয়েছে, ‘অবশ্যই ফ্রিজে ১৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। এতে প্রাকৃতিক টারটারিক অ্যাসিড, সাইট্রিকসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক অ্যাসিডের উপস্থিতি রয়েছে। চিনি, প্রিজারভেটিভ ও আমের কৃত্রিম ফ্লেভার যোগ করা হয়নি।’ এতে ফাঙ্গাস আসার আশঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করা হয়েছে ভোক্তাদের।
মঈনুল আনোয়ার জানান, তাঁরা ফজলি থেকে শুরু করে আম্রপালি, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, গৌড়মতিসহ আরও যত রকম আম আছে, সবগুলো জাত থেকেই আমসত্ত্ব বানিয়েছেন। এর মধ্যে ফজলি ও আশ্বিনা আমের আমসত্ত্ব সবচেয়ে ভালো হয়েছে। তাঁরা এখন মিষ্টি ও টক–মিষ্টি আমের আমসত্ত্ব তৈরি করেন। এর মধ্যে যাঁদের মিষ্টি খাওয়া নিষেধ, অর্থাৎ যাঁরা ডায়াবেটিসের রোগী তাঁরা টক মিষ্টি আমসত্ত্বটা খেতে পারেন। এটাতে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজের পরিমাণ কম। সাকসিনিক অ্যাসিড ও ম্যালেয়িক অ্যাসিডের কারণে এটি খেতে টক লাগে।
এই উদ্যোক্তা জানান, তিনি ঐতিহ্যবাহী তথা প্রচলিত ধারার আমসত্ত্বের পাশাপাশি দুধ দিয়েও আমসত্ত্ব তৈরি করেন। এ ছাড়া তিনি পরীক্ষামূলকভাবে আমের সঙ্গে তিল দিয়ে এবং মসলা দিয়েও আমসত্ত্ব তৈরির করছেন।
মঈনুল আনোয়ার জানান, সাধারণত পাঁচ থেকে সাত কেজি আমে এক কেজির মতো আমসত্ত্ব তৈরি হয়। এটি শুধু আমের রস দিয়েই তৈরি হয়। তাঁরা কোনো কেমিক্যাল (রাসায়নিক) ও চিনি ব্যবহার করেন না।
গ্রামের মহিলারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই আমসত্ত্ব তৈরি করে দেন। এতে তাঁদের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। এ রকমই একজন হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর গ্রামের গৃহিণী মারুফা খাতুন। সম্প্রতি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মারুফা প্রথম আলোকে জানান, তিনি এবার আমসত্ত্ব বানিয়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করেছেন। সেই টাকা দিয়ে দুটি খাসি কিনে এখন পালছেন। তিনি নিজের আম দিয়ে যেমন আমসত্ত্ব বানিয়েছেন, মঈনুল আনোয়ারের দেওয়া আমেরও আমসত্ত্ব তৈরি করেছেন।
রপ্তানির সম্ভাবনা সম্পর্কে মঈনুল আনোয়ার বলেন, ‘বিদেশে আমসত্ত্বের ভালো চাহিদা রয়েছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে আমরা রপ্তানি করতে পারব। আমসত্ত্বকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করব।’