Skip to content

আফ্রিকায় বাড়ছে গাধা চুরি, মূল কারণ চীনে

    আফ্রিকায় বাড়ছে গাধা চুরি, মূল কারণ চীনে prothomasha.com

    পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত গাধাটি বোধ হয় ছিল মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার। সে গল্প আলাদা। বিখ্যাত না হলেও পৃথিবীতে এখনো বহু গাধা আছে গৃহপালিত পশু হিসেবে এবং অতি অবশ্যই ভারবহনের প্রয়োজনে। বিশেষত আফ্রিকায় গৃহপালিত পশু হিসেবে গাধা বেশ জনপ্রিয়। অঞ্চলটির দুর্গম পথ–ঘাটে মালপত্র পরিবহনের কাজে এর উপযোগ তৃণমূল পর্যায়ে তুলনাহীন। কিন্তু এই গাধার দিকেই গেছে চোরের দৃষ্টি। আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে বেড়েছে গাধা চুরি। কিন্তু কেন?

    ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি শুরু করেছে স্টিভ নামের এক ২০ বছর বয়সী তরুণের কথা দিয়ে। নিজের আয়–রোজগারের জন্য স্টিভ অনেকটাই তার পোষা গাধাগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একদিন নাইরোবির এই তরুণ তার গাধাগুলোকে আর খুঁজে পেল না। রীতিমতো অসহায় এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলো তাকে। ঠিক ধরেছেন। স্টিভের গাধাগুলো চুরি গেছে।গোটা আফ্রিকায় এমন স্টিভের সংখ্যা এখন অনেক। কারণ, পুরো অঞ্চলেই গাধার দিকে চোরদের দৃষ্টি গেছে ব্যাপকভাবে। অবশ্য শুধু আফ্রিকা কেন, সারা পৃথিবীতেই গাধা চুরি বেড়েছে। কারণ কী?

    বিবিসি জানাচ্ছে, গাধা চুরির কারণ এর চামড়া। চীনে এক ধরনের ওষুধ তৈরির জন্য যে জিলাটিনের প্রয়োজন হয়, তা পাওয়া যায় গাধার চামড়ায়। ফলে দেশটিতে গাধার চামড়ার চাহিদা ভীষণভাবে বেড়েছে। এই চাহিদারই দায় শোধ করতে হচ্ছে কেনিয়ার নাইরোবির স্টিভের মতো আরও অনেককে। চীনে গাধার চামড়া থেকে পাওয়া বিশেষ জিলাটিন দিয়ে এক ধরনের ওষুধ প্রস্তুত করা হয়, যা স্থানীয় ভাষায় ইজিয়াও নামে পরিচিত।

    ওই যে চর্যার পদ আছে না—আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। গাধার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। নিজের চামড়ায় থাকা জিলাটিনই তার মৃত্যু ডেকে আনছে। হরিণের ক্ষেত্রে যেমন তার সুস্বাদু মাংসই তার মৃত্যুর কারণ।চীনের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে—ইজিয়াও সুস্বাস্থ্য শুধু নয়, যৌবন ধরে রাখতেও কার্যকর। ফলে গাধার চামড়া থেকে জিলাটিন আলাদা করে প্রস্তুত করা হয় ইজিয়াও। এটি গুঁড়া, ট্যাবলেট, তরল—নানাভাবে বাজারে বিক্রি করা হয়। কেউ সরাসরি ওষুধের মতো এটি গ্রহণ করে। আবার কেউ চা বা নানা খাবারের সাথে মিশিয়ে এটি গ্রহণ করে।

    এই ইজিয়াও চীনে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, যৌবন ধরে রাখতে বা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার অদম্য ইচ্ছায় বিশেষত আফ্রিকায় প্রাণ দিতে হচ্ছে অসংখ্য গাধার। কতটি? ২০১৭ সাল থেকে গাধার অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে কাজ করা সংস্থা ডঙ্কি স্যাংচুয়ারির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে—প্রতি বছর সারা বিশ্বে শুধু এই অবৈধ ব্যবসার কারণে প্রাণ দিতে হয় ৫৯ লাখ গাধাকে। তারা বলছে, এই চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিবিসি অবশ্য তাদের এই হিসাব যাচাই করে দেখতে পারেনি। তবে সংখ্যাটি যদি এর কমও হয়, তাও অর্ধকোটির আশপাশেই হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

    ডঙ্কি স্যাংচুয়ারির কর্মী সলোমন ওনিয়াঙ্গো বিবিসিকে বলেন, ‘শুধু ২০১৬–১৯ সময়ের মধ্যেই এই চোরাকারবারিদের দৌরাত্মে কেনিয়ায় গাধার সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।’গাধা প্রসঙ্গে আফ্রিকার কথা বিশেষভাবে উঠে আসারও কারণ আছে। বিবিসির তথ্যমতে, বিশ্বে কম–বেশি ৫ কোটির বেশি গাধা আছে। এর দুই–তৃতীয়াংশেরই বাস আফ্রিকায়। অঞ্চলটিতে এ নিয়ে একেক দেশে একেক নীতি আছে। কোনো দেশে গাধার চামড়ার বিক্রি–বাট্টার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, আবার কোনো দেশে এটি বৈধ। কিন্তু অবৈধ বা বৈধ যা–ই হোক—উচ্চমূল্যের কারণেই অঞ্চলটিতে গাধা চুরি অত্যধিক বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যেটি করা হয়, নিষেধাজ্ঞা থাকা অঞ্চল থেকে গাধা চুরি করে তা বৈধতা আছে এমন দেশে নিয়ে বধ করে তার চামড়া বিক্রি করা হয়।

    এ অবস্থায় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ও ব্রাজিলের সরকার একটি নীতিগত সিদ্ধান্তে এসেছে যে, তারা সব দেশেই গাধার চামড়া বিক্রি নিষিদ্ধ করবে। আগামী ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উঠছে।চীনে এর চাহিদা কতটা তা একটি তথ্য থেকেই বোঝা যাবে। দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে যেখানে দেশটিতে ১ কোটি ১০ লাখ গাধা ছিল, এখন সেখানে কম–বেশি ২০ লাখের মতো গাধা আছে। কিন্তু এর বিপরীতে দেশটিতে ইজিয়াওয়ের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপকভাবে।

    এই চাহিদা মেটাতেই এখন চীনের বিভিন্ন কোম্পানি আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দেশ থেকে গাধার চামড়া সংগ্রহ করছে। এটি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে, চীনের সাথে গাধার চামড়া নিয়ে নানা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বলা যায় এক ধরনের বাণিজ্য দ্বৈরথ চলছে। এমনকি এই দ্বৈরথ চীনের বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যেও হচ্ছে—কে কার আগে কোথা থেকে তাদের চাহিদা পূরণ করবে।এই বাণিজ্য লড়াইয়ের জেরে আফ্রিকার দেশে ইথিওপিয়ায় রীতিমতো আন্দোলন হয়েছে। দেশটিতে এমনিতেই গাধার মাংস খাওয়া নিষেধ। তারপরও চীনা চাহিদা পূরণে সেখানে গাধা জবাইখানা স্থাপন করা হয়। ২০১৭ সালে এ নিয়ে দেশটিতে বিক্ষোভ হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এর জেরে শেষ পর্যন্ত কসাইখানা বন্ধ করা হয়। ২০২২ সালে তানজানিয়া ও আইভোরি কোস্ট একই পদক্ষেপ নেয়।

    তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ নিয়েছে পাকিস্তান। চীনের এই ঐতিহাসিক বন্ধু রাষ্ট্র কসাইখানা বন্ধের বদলে বরং গাধা উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছে। সরকারিভাবে এই উদ্যোগ নিয়েছে ইসলামাবাদ। করবে না কেন? সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লরেন জনস্টনের বরাত দিয়ে বিবিসি জানাচ্ছে, ২০১৩ সালে এই বাণিজ্যের আকার ছিল ৩২০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার।

    এদিকে গাধা চুরির শিকার হচ্ছে বেশি গরীব কৃষক। তাদের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে পণ্য পরিবহনের কাজে এটিই তাদের একমাত্র সম্বল। প্রিয় পোষ্য প্রাণীটির মৃত্যু তাদের অথৈ সাগরে নিয়ে ফেলে। তৃণমূল পর্যায়ের এই মানুষগুলো আক্রান্ত হলে আবার অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। ফলে আফ্রিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর কাছে এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাদের অর্থনীতির জন্য কোনটি বেশি প্রয়োজন—জীবিত, নাকি মৃত গাধা?