আইপিএলে ধারাভাষ্য দিতে ইচ্ছা হয় না?প্রশ্ন করতে যা একটু সময়, উত্তর দিতে দেরি করলেন না মাইকেল হোল্ডিং, ‘আমি শুধু ক্রিকেটেই ধারাভাষ্য দিই।’ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–এর যে সাংবাদিক প্রশ্নটি করেছিলেন, তিনি আর কথা বাড়ালেন না। একলাফে চলে গেলেন হোল্ডিংয়ের সময় আর বর্তমানের বাউন্সারের নিয়ম ও কনকাশনবিষয়ক প্রশ্নে। হোল্ডিং সত্তর–আশির দশকে খেলা টেস্ট ক্রিকেটার।
টি–টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে বিরক্তি আছে। এমন কারও আইপিএলকে ক্রিকেট মনে না–ই হতে পারে। তবে আইপিএল যে স্রেফ ক্রিকেট নয়, এর বাইরে আরও অনেক কিছু, সেটি গৌতম গম্ভীরের এক মন্তব্যেও স্পষ্ট। অধিনায়ক হিসেবে দুবার কলকাতা নাইট রাইডার্সকে ট্রফি জেতানো এই সাবেক ভারতীয় ওপেনার এবার মেন্টর হিসেবে একই দলে ফিরেছেন। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে খেলোয়াড়দের মনে করিয়ে দিয়েছেন, আইপিএল মানে কিন্তু বলিউড বা ম্যাচের পর পার্টি নয়। আইপিএল কিন্তু ক্রিকেটই। মাঠের ক্রিকেট।
শাহরুখ খান–জুহি চাওলার দলের একজন বলেই হয়তো গম্ভীরের মুখে বলিউডের কথা এসে থাকতে পারে। কিন্তু আইপিএল যে বলিউড আর পার্টি ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেটি উঠে এসেছে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সাম্প্রতিক মন্তব্যে। ১৬ বছর ধরে আইপিএল খেলে চলা ভারতের তারকা স্পিনার এর বিশালত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, ‘কখনো কখনো আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট! কারণ, (আইপিএলের সময়) খেলাটাই যেন পেছনে পড়ে যায়। এটা এত বড়…আমাদের বিজ্ঞাপনের শুটিং ও সেটে অনুশীলন সারতে হয়! আইপিএল এখন এমন একটা অবস্থায়ই চলে গেছে।’ আইপিএল যে অনেক বড়—দর্শক আগ্রহে, অর্থের ঝনঝনানিতে আর ক্রিকেটীয় বিনোদনে অনেক বড় অবস্থানে চলে গেছে, সেটা পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। গত বছরের আইপিএল ফাইনালে শুধু জিও সিনেমাতেই একই সময়ে (কনকারেন্ট) খেলা দেখেছেন ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি দর্শক।
২০২২ সালে পাঁচ বছরের জন্য আইপিএল মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি রুপিতে, যা ম্যাচপ্রতি মিডিয়া স্বত্ব আয়ে পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন খেলার লিগগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের এনএফএল)। গোটা বিশ্বে পরিচিত ফুটবলের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বাস্কেটবলের এনবিএ-তেও মিডিয়া স্বত্বের দাম এর চেয়ে কম। স্বাভাবিকভাবেই আইপিএলের দুই মাসে ক্রিকেট দুনিয়ার নজর তাক করা থাকে ভারতের এই লিগের দিকে। কিন্তু বাতির নিচের অন্ধকারের আইপিএলেও আছে ছায়াপথের উপস্থিতি। খুব রূঢ় ভাষায় যার সারমর্ম হয় ২০২১ সালে ক্যারিবীয় পেস কিংবদন্তি হোল্ডিংয়ের বলা কথাটাই—ওটা ক্রিকেট নয়। কেন শুধুই ক্রিকেট নয়, তার কিছুটা আভাস আছে গম্ভীর আর অশ্বিনের কথায়। কিন্তু মোটাদাগের লাল কথাগুলো খেলায়, বাণিজ্যে আর মানসিকতায়। আইপিএলের মহিরুহ হয়ে ওঠার দৃশ্যমান কারণ যেহেতু আর্থিক, বাণিজ্যিক দিকটাতেই আলো ফেলা যাক আগে।
২০২২ সালে বিসিসিআই যখন আইপিএলে নতুন দুটি দল বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে, তখন ২৭ কোটি মার্কিন ডলার ভিত্তিমূল্যের দল কিনতে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ভারত ও ভারতের বাইরের বড় বড় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো। বিসিসিআই নিজেরাই যেখানে ৩০ কোটি ডলারের কম প্রত্যাশা করেছে, সেখানে লক্ষ্ণৌ ও গুজরাট ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য প্রস্তাব আসে ৯৪ কোটি ও ৭৫ কোটি ডলারের! ওই ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরেই দেশের মাটিতে ভারতের ছেলে ও মেয়েদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য টাইটেল স্পনসর হয়েছিল মাস্টারকার্ড। এ জন্য ম্যাচপ্রতি তারা দিয়েছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ রুপি করে। চুক্তি ছিল এক বছরের।
২০২৩ সালের মার্চ থেকেই পরবর্তী চুক্তির জন্য স্পন্সর খোঁজা শুরু করে বিসিসিআই। কিন্তু আইপিএলের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়া স্পনসর দূরে থাক, প্রত্যাশিত মাত্রার আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সাড়াও পায়নি ভারতীয় বোর্ড। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দরপত্রের ভিত্তিমূল্য কমিয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ রুপি করে বিসিসিআই। এরপর দুটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখালে প্রতিটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য সর্বোচ্চ ৪ কোটি ২০ লাখে স্বত্ব পায় আইডিএফসি ফার্স্ট।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয় ইরানি ট্রফি, দুলিপ ট্রফি, রঞ্জি ট্রফিসহ বিসিসিআই আয়োজিত সব জুনিয়র দলের (অনূর্ধ্ব–১৯ ও অনূর্ধ্ব-২৩) দলের ম্যাচও। অর্থাৎ, ৪০ লাখ রুপি বেশি হলেও খেলার আওতা বাড়ায় আদতে তা একই বা কমও বলা চলে। অথচ ভারতজুড়ে গত কবছরের ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা যে হারে বেড়েছে, জাতীয় দল ঘিরে স্পনসরদের আগ্রহও বাড়ার কথা সমানতালে। সেই বিসিসিআইরই কিনা জাতীয় দলের স্পনসর খুঁজতে খুঁতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগে গেছে! বাণিজ্যিক দিকের বাইরে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের ক্রিকেটেও। বেশি দূর নয়, সাম্প্রতিক সময়েই তাকানো যেতে পারে। আইপিএল শুরুর আগে ভারতীয় ক্রিকেট ব্যস্ত ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ টেস্টের সিরিজ নিয়ে। সিরিজের শেষ দিকে আইপিএল বনাম জাতীয় দলবিষয়ক আলোচনা বেশ আলোড়ন তোলে।
গত বছরের শেষ দিকে ঈশান কিষান ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দল থেকে ফিরে আসার পর কোচ রাহুল দ্রাবিড় তাঁকে রঞ্জি ট্রফিতে খেলতে বলেছিলেন। কিন্তু ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্টটিতে কিষান অংশ নেননি। একই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, হার্দিক পান্ডিয়ার সঙ্গে অনুশীলন করছেন কিষান। দুজনই আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের খেলোয়াড়। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আইপিএলের জন্য।
আইয়ার অবশ্য ভারতের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম দুই টেস্টের দলে ছিলেন। তৃতীয় টেস্টের আগে তাঁকে রঞ্জিতে খেলার জন্য দল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আইয়ারও শুরুতে রঞ্জিতে খেলতে চাননি। বলেন, পিঠব্যথায় ভুগছেন। যদিও ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি থেকে বোর্ডকে জানানো হয়, আইয়ারের এ ধরনের সমস্যার বিষয়ে তারা অবগত নয়। আইয়ার, কিষানের দুজনেরই রঞ্জি বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় আইপিএল। যে কারণে বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেই বাদ দেওয়া হয় দুজনকেই। আইপিএলের কারণে জাতীয় দলে মনোযোগ কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ কিন্তু শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিপুল অর্থের হাতছানি আছে বলে লাসিথ মালিঙ্গার টেস্ট থেকে অবসর নিয়ে আইপিএলে খেলা, ক্রিস গেইলের জাতীয় দলকে বারবার উপেক্ষা করায়ও জড়িয়েছিল আইপিএলের নাম। এ ছাড়া আইপিএলেই নিবিড় মনোযোগে নিজের সেরাটা দিয়ে খেলেন—এমন অভিযোগ তো আছে অনেকের বিরুদ্ধেই।
আইপিএলের মাধ্যমে ক্রিকেটে নতুন এক অধ্যায় যুক্ত করা ভারত ২০১৩ সালের পর কোনো আইসিসি ট্রফি জেতেনি। অথচ এ সময়েই দলটির হয়ে খেলেছেন বিরাট কোহলি, এম এস ধোনি ও রোহিত শর্মাদের মতো ক্রিকেটার। গত বছর দুটি আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে হেরেছে ভারত, একটি নভেম্বরে ওয়ানডে বিশ্বকাপে। আরেকটি জুনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে। এর মধ্যে ওভালে হওয়া টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল শুরু হয়েছিল ২০২৩ আইপিএল ফাইনালের সপ্তাহখানেক পরেই।
টেস্টের ফাইনালে শেষ দিনে অধিনায়ক রোহিত ও কোহলি যেভাবে আউট হয়েছিলেন, সেটিতে অনেকেই আইপিএলের প্রভাব দেখেছিলেন। ফাইনাল চলার সময়ই সাবেক কোচ ও ক্রিকেটার রবি শাস্ত্রী বিসিসিআইকে জাতীয় দল ও আইপিএলের মধ্যে অগ্রাধিকার ঠিক করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসকে কোচিং করানো রিকি পন্টিং বলেছিলেন, ভারতের খেলোয়াড়েরা আইপিএল নিয়ে ব্যস্ততার কারণেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেনি। লিগভিত্তিক ফুটবল খেলাই যেখানে বিশ্বকাপ বা মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের সময় জাতীয় দলকে প্রাধান্য দেয়, সেখানে জাতীয় দলভিত্তিক ক্রিকেটে ভারতের এমন আচরণ তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এ ক্ষেত্রে ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের মানসিকতার বিষয়ও ভাবার মতো। ভারত ২০০৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ার পর বিসিসিআইয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা রত্নাকর শেঠি জানিয়েছিলেন, কিছু তরুণ তখনই রঞ্জির চেয়ে আইপিএলকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে শুরু করেছিলেন। ভারতের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে বিদায়ে তারা বেদনাহত হয়নি বলে তার কাছে অভিযোগ করেছিলেন এক সিনিয়র ক্রিকেটার। এখন ২০২৪ সালে এসে যাঁরা নতুন হিসেবে আইপিএলে ঢুকছেন, তাঁরা বেড়ে উঠেছেনই আইপিএল দেখে। সুতরাং আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখনকার তরুণদের চোখে আইপিএল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় দলের হয়ে কিছু অর্জনের ক্ষুধাও তাই কারও কারও কাছে তুলনামূলক কমই মনে হওয়ার কথা।
ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী রমাচান্দ্র গুহর চোখে আইপিএল পুঁজিবাদের দোষে দুষ্ট। ২০১৩ সালে দ্য হিন্দুতে লেখা কলামে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যগুলোর কয়েকটির নামে ফ্র্যাঞ্চাইজি না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছিলেন, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ‘ইন্ডিয়ান’ই নয়। লক্ষ্ণৌ, গুজরাটের মতো দলগুলো যুক্ত হওয়ার পর আইপিএল ‘ভারতীয়’ হয়েছে কি না, রমাচান্দ্রই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটি ক্রিকেট কি না, সেই বিতর্ক হতেই পারে। অন্তত বিসিসিআইয়ের জাতীয় দলের স্পনসর পাওয়ার জটিলতা, কিষানদের আইপিএলকে প্রাধান্য দেওয়া, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়া মিলিয়ে এমন প্রশ্ন তোলাই যায়।