নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার অংশ হিসেবে ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে একটি সেল গঠন করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল।’ কিন্তু এই সেল না করছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোনো পর্যালোচনা, না দিচ্ছিল এ বিষয়ে কোনো পূর্বাভাস। ভোক্তা ও আমদানিকারকদের স্বার্থে সেলটিকে কার্যকর করার পরিবর্তে বরং তা একপ্রকার বন্ধই করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এক মাস আগেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা ছিল, ‘দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল নিত্যপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানির পরিমাণ, মজুত ও সংগ্রহ পরিস্থিতি এবং বিতরণব্যবস্থাসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে থাকে। সেলটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারদরের তুলনামূলক বিশ্লেষণও করে।’
বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিত্যপণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারদর, বন্দরে পণ্য খালাসের পরিমাণ, আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির তথ্য নিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করা এবং এরপর বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের করণীয় নির্ধারণেও সহায়ক হিসেবে কাজ করার কথা এই সেলের। ওয়েবসাইট থেকে হঠাৎ এসব কথা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইটের দৃশ্যমান জায়গা থেকে সেলটির নামও উধাও হয়ে গেছে। ইমরান আলম নামের একজন আমদানিকারক বলেন, নিত্যপণ্য–সম্পর্কিত যথেষ্ট তথ্য সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় না। কখন পণ্য আমদানি করতে হবে, তা জানানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারত এই সেল।
ভোক্তা ও আমদানিকারকেরা আলাপকালে জানান, নিয়মিত দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও এটা নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া হলে দেশে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এগুলোর দাম সম্পর্কে তাঁরা জানতে পারতেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘মোটেও সরে আসা হয়নি। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সঙ্গে যৌথভাবে কাজটি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ কাজ এখন আরও জোরদার হবে।’
দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলটি ছিল আইআইটি অনুবিভাগের আওতাধীন। তেমন কোনো কাজের প্রমাণ না থাকলেও এতে দুজন কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিলেন। আইআইটি অনুবিভাগের প্রধান হিসেবে আছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রেজওয়ানুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেল যে ধরনের কাজ করত, তা করে দিচ্ছে বিটিটিসি এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সম্প্রতি সেলের দুজন কর্মকর্তা বদলি হয়ে গেছেন। বিটিটিসির একজন কর্মকর্তা সহযোগিতা করছেন।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, দ্রব্যমূল্যের সার্বিক পরিস্থিতি অর্থাৎ উৎপাদন, আমদানি ও মজুত ইত্যাদি নিয়ে প্রতি মাসে একটা বৈঠক হয়। এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি), সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা উপস্থিত থাকেন।
বৈঠকগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি, বিটিটিসি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারের তুলনামূলক পার্থক্য এবং এনবিআর কর-সংবলিত তথ্য উপস্থাপন করে থাকে। ব্যবসায়ীরাও নিজেদের অসুবিধার কথা জানিয়ে বক্তব্য দেন। খুচরা ব্যবসায়ী বা ভোক্তাদের কোনো প্রতিনিধিকে এ ধরনের বৈঠকে ডাকা হয় না। ফলে বৈঠক থেকে ভোক্তাস্বার্থ-সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত আসাটা কঠিন হয়ে পড়ে। বৈঠকের তথ্য কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ক্যাব) অনেক সময় জানানোও হয় না।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর আগে আমি যখন বাণিজ্যসচিব ছিলাম, তখন এসব সেল গঠনের কিছু ছিল না। কারণ, বাজার ছিল স্থিতিশীল। এখন দরকার আছে। পর্যালোচনা ও পূর্বাভাসের কাজ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে বিটিটিসি করছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। ফলে তারাই এর জবাব দিতে পারবে।’ গোলাম রহমান আরও বলেন, তেল–গ্যাস ও বিদ্যুৎ ছাড়া সবই তো এখন বেসরকারি খাতে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ এখন থাকে না। এমন অবস্থা তৈরি করা সার্বিক বিবেচনায় ঠিক নয়।