হাওর থেকে কাটা ধানের আঁটি এনে খলায় রাখছেন কেউ কেউ। সেই আঁটি আবার পাশেই মেশিনে মাড়াই করা হচ্ছে। কড়া রোদ থাকায় মাড়াই করা ধান সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে শুকাতে। নারী-শিশুরা খলায় সেই ধান নেড়ে দিচ্ছেন। কেউবা শুকনা ধান বাতাসে উড়িয়ে পরিষ্কার করছেন। কৃষক পরিবারের সবাই এখন মহা ব্যস্ত। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই তাঁদের।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের পাড়ে গত বুধবার এ দৃশ্য চোখে পড়ে। শুধু শনির হাওর নয়, সুনামগঞ্জের ১৩৭টি ছোট–বড় হাওরের সব কটিতেই এখন ধান তোলার এই উৎসব চলছে। বোরো ধান গোলায় তুলতে ব্যস্ত সবাই। বুধবার পর্যন্ত জেলায় ১ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে, যা মোট আবাদের ৫৬ ভাগ। বৈশাখের শুরুতে ঝড়বৃষ্টিতে কৃষকের মনে যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা কেটে গেছে। আপাতত সুনামগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই। তাই হাওরে আনন্দে ধান কাটছেন কৃষকেরা।
কৃষকেরা বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরের প্রধান ফসল এই বোরো ধান। শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান নির্বিঘ্নে গোলায় তুলতে পারলেই হাওরের কৃষক ধনী। অকালবন্যা, অতিবৃষ্টি কিংবা অন্য কোনো কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকের পরিবারে দুঃখের সীমা থাকে না। সারা বছরের খাবার তো বটেই, এই ধানকে নিয়ে কত স্বপ্ন, কত আশা থাকে। সন্তানের লেখাপড়া, বিয়েশাদি, উৎসব-আনন্দ সবকিছুতেই এই ধানের ওপর নির্ভর করেন হাওরবাসী। সারা বছর যে কৃষক হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন, তাঁর ভাবনায় থাকে যে ধান উঠলে সেই ধান বিক্রির টাকায় স্ত্রীর জন্য একটি নতুন শাড়ি, কিংবা বৃদ্ধ মা-বাবাকে শাড়ি-লুঙ্গি কিনে দেবেন।
প্রচণ্ড দাবদাহে ওষ্ঠাগত প্রাণপ্রকৃতি, এসবে কোনো ভাবনা নেই কৃষক নূর কালামের (৪০)। খাঁ খাঁ রোদের মধ্যেই ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে হাওর থেকে খলায় এনে রাখছিলেন তিনি। সঙ্গে আরও কয়েকজন। নূর কালাম বলেন, ‘সারা বছরের জোগাড় ১৫ দিনে তুলতে অইব। মেঘ-তুফান, রইদ ইতার চিন্তা করার সময় নাই। ধান না তুলতে পারলে সারা বছর কষ্ট খরত অইব।’
নূর কালামের বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরপারের চিকসা গ্রামে। দুপুরের কাঠফাটা রোদের মধ্যে হাওর থেকে কাটা ধানের আঁটি মাথায় করে পাড়ে এনে রাখছিলেন তাঁরা কয়েকজন। কৃষক নূর কালাম জানান, হাওরে এবার সাত বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। এপ্রিলের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় হাওরের তলায় পানি জমেছে। তাই যন্ত্রে সেই ধান কাটাতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে নিজেই ধান কাটছেন। তিন বিঘা জমি কেটে মাড়াই ও শুকিয়ে গোলায় তুলেছেন। বাকি ধান তুলতে আর পাঁচ দিন লাগবে।
হাওরপাড়ের একটি করচগাছের নিচে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন কৃষক নূর কালাম, জমিস উদ্দিন, তহুর আলী ও সাহার উদ্দিন। নূর কালাম বলেন, তাঁর পরিবারে মা, স্ত্রী আর তিন ছেলে–মেয়েসহ ছয় সদস্য। এক ছেলে ও এক মেয়ে স্কুলে যায়। এই ধানেই পরিবারের পুরো এক বছরের সব ব্যয় নির্বাহ হয়। জসিম উদ্দিন বলেন, এবার ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় সবাই খুশি। আর ১৫ দিন সময় পেলে পুরো হাওরে ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। সারা দেশেই দাবদাহ চলছে, এতে কষ্ট হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সাহার উদ্দিন বলেন, ‘হাওরো বৈশাখ মাসো রইদ যত বেশি, আমরার তত ভালা। ধান কাটা, শুকানো—সবতাই হাওরে করা যায়।’
সুনামগঞ্জ শহর থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা হয়ে তাহিরপুর যাওয়ার সময় খরচার হাওর, শনির হাওরে ধান কাটা-মাড়াইয়ে কৃষকের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। পথে খরচার হাওরপাড়ে কথা হয় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক নুরুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এবার প্রথম দিকে ধান কাটার যন্ত্রের সংকট ছিল। এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব যন্ত্রের মালিকেরা কৃষকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিচ্ছেন। গত বছর যেখানে ৩০ শতক ধান কাটা-মাড়াইয়ে ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দিলেই হয়েছে। এবার ডিজেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সেটা দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা নিচ্ছেন তাঁরা।
তাহিরপুর উপজেলা সদরের পশ্চিমে ভাটি তাহিরপুর গ্রামের পাশ থেকেই শনির হাওর শুরু। শনির হাওর জেলার তিনটি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। হাওরপাড়ের খলায় ছাতা মাথায় দিয়ে ধান শুকানো, বস্তায় ভরার কাজ তদারক করছিলেন ষাটোর্ধ্ব দম্পতি ইসহাক ইসলাম ও ফাতেমা ইসহাক। গ্রামের বড় গৃহস্থ পরিবার তাঁদের। হাওরে ১৮ একরের মতো জমি আছে। কিছু জমি নিজে আবাদ করান, বাকিটা বর্গা দেন। ফাতেমা ইসহাক বলেন, ধান কেটে ঘরে তুলতে একসময় কত কষ্ট করেছেন কৃষক পরিবারের লোকজন। সবকিছুই নিজেদের করতে হতো। বৈশাখে দিন–রাত ধান তোলার কাজ করতে হয়েছে। এখন মেশিনে ধান কাটে, মাড়াইও করে। আবার হাওর বা খলা থেকেই শুকিয়ে ভ্যানে করে ধান বাড়িতে নেওয়া যায়। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরে বোরো ধানের আবাদ হয়। এবার জেলার হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ৫৬ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। আগামী ৫ মের মধ্যে গভীর হাওরের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। ধান কাটায় কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘হাওরে ডিসেম্বর মাস থেকে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। সেই থেকে আমরা মাঠে আছি। কৃষকদের ফসল তোলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাঁদের পাশেই আছি। কৃষকেরা খুশি। আমরা কৃষকদের মুখে সব সময় এই হাসিটাই দেখতে চাই।’
prothomasha.com
Copy Right 2023