বিশ্ব বাজারে পণ্যের দামে ওঠানামা, ডলার সংকট, চাঁদাবাজিসহ নানা যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কিছু দিন পরপর এই সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, চিনি থেকে শুরু করে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ডিম ইত্যাদি নিত্যপণ্যেরে দাম বাড়ানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, উঁচু পর্যায়ের এই সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাবশালী এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্টরা থাকায় এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।
সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এই সিন্ডিকেটের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কখনো বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে বিএনপির পুরোনো সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য নিয়ে বাজারে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে সরকার এখন তাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে। সরকারি দলের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বাজারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
আর বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও ক্রেতা সুরক্ষায় কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। ভোক্তাসাধারণকে জিম্মি করে প্রতি বছর হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দায় চাপিয়ে বাজার সিন্ডিকেটকে আরও সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন রাঘব বোয়ালরা। বর্তমান সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। এ পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারের লাগাম টানতে দাম বেঁধে দেওয়া, অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করা, বিদেশ থেকে আমদানিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সিন্ডিকেট চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অতীতে সিন্ডিকেটের সামনে কখনো খোদ বাণিজ্যমন্ত্রীকে অসহায় বোধ করতে দেখা গেছে। বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও তা কোনো কাজে আসছে না। বরং মন্ত্রীরা বাজার সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ে কেউ যাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মনোপলি করতে না পারে সে জন্য ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। কিন্তু আইন করেও ঠেকানো যায়নি বাজার সিন্ডিকেট। আবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও ক্রেতাকে সুরক্ষা দিতে কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
সর্বশেষ গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি দ্রব্যমূল্য নিয়ে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে মজুদদার ও সিন্ডিকেটদের পৃষ্ঠপোষকতা ও মদদ দিচ্ছে। বিএনপির পুরোনো সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য নিয়ে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে। তবে যে অশুভ চক্র দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জন-অসন্তোষ সৃষ্টি করছে, তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে গতকাল পৃথক আরেক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সিন্ডিকেট নিয়ে সরকার উদ্ভট কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। বাজার নিয়ন্ত্রকরাই এখন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আওয়ামী লীগের অসাধু সিন্ডিকেট রাজনৈতিক ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এখন বাজারের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিদিন মানুষের পকেট থেকে বাড়তি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মানুষের এখন জান বাঁচানো দায়। সরকার লোক দেখানো হাঁকডাক দিলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকার এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দায়ও চাপাচ্ছে বিএনপির ওপর।
সিন্ডিকেটে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা যুক্ত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে মনে করে ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন সময়ের আলোকে বলেন, আসল তথ্য আড়াল করতেই মন্ত্রীরা সিন্ডিকেট নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন। কারণ সিন্ডিকেটে কারা রয়েছেন তার সব তথ্যই গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারের কাছে আছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় সরকার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন মনে করছে না। তাদের কারও বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়নি, শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এই গাফিলতির কারণে বর্তমানে সিন্ডিকেটের সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যাদের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা, তারা তা সঠিকভাবে পালন করছে না।
তিনি বলেন, আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে বারবার দাবি জানানো হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের বাজার অস্থির, সরকার এটি দীর্ঘদিন স্বীকারই করেনি। যদি যথাসময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তা হলে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো। সরকারের ১১টি সংস্থা বাজার তদারকির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শুধু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকে বাজারে পাওয়া যায় না।ক্যাবের সহ-সভাপতি বলেন, মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে প্রভাব বিস্তার করছে ব্যবসায়ীরা। তাই বাজার ব্যবস্থাপনার যেকোনো সিদ্ধান্তে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং প্রতিযোগিতা কমিশন। তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠ পর্যায়ে খুচরা ও পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করলেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম খুবই সীমিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের বুঝাপড়া থাকায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
শুধু কয়েকটি বাজারে নজরদারি এবং জেল- জরিমানা করে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা অসম্ভব বলে মনে করছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তার মতে ব্যবসায়ীদের অসাধু তৎপরতা থেকে স্থায়ীভাবে বাজারকে বের করে আনতে না পারলে শুধু জেল-জরিমানা করে লাভ হবে না। এ ক্ষেত্রে বিপণন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় বিপণন ব্যবস্থার ভেতরে যে অনিয়ম ও অস্থিরতা চলছে সেটি সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করা না গেলে, শুধু অভিযানে কোনো কাজ হবে না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, কোনো দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে গেলে দামও আস্তে আস্তে বাড়ে। তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি অলিখিত সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত বলে মনে করেন না তিনি। আবার কোনো পণ্যের সরবরাহ কম থাকলেও ওই সেক্টরের সমিতির মাধ্যমে অদৃশ্য সিন্ডিকেট হয় এবং দাম বেড়ে যায়। এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো জিনিসের চাহিদা কখন বাড়বে বা সংকট তৈরি হতে পারে, তা আগে থেকেই মোটামুটি বোঝা যায়। তাই ওই সময়ে ওই পণ্য প্রয়োজনে আমদানির ব্যবস্থা করলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
তার মতে সমস্যা সৃষ্টির আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংকট তৈরি হয়ে দাম বেড়ে যাওয়ার পর দাম নির্ধারণ করে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ তখন দাম নির্ধারণ করতে চাইলে একটি গ্রুপ সরকারের সঙ্গে বসে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে সুবিধা মতো দাম নির্ধারণ করে। ফলে সরকারের উচিত সিন্ডিকেট ঠেকাতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নজরদারি করে বাজার কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বলে মনে করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি বলেন, ‘বাজারের একটা সাপ্লাই চেইন আছে। এ সাপ্লাই চেইনে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে প্রত্যেককে যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজারে যে পণ্য ঢুকছে তা কিন্তু অবিক্রীত থাকছে না। কেউ আবার খালি হাতেও ফিরছে না। দেশে কিন্তু একসময় খাদ্যের সংকট ছিল। তখন টাকা দিলেও বাজারে খাদ্য পাওয়া যেত না। সেখান থেকে আমরা বের হয়ে এসেছি। মানুষের হাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা আছে।কারসাজি করে যারা নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, তাদের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘চক্রান্ত’ ও ‘পরিকল্পনা’ করে জিনিসের দাম বাড়ানো হয়। মজুদ করে রেখে পচিয়ে যারা বস্তায় বস্তায় পেঁয়াজ পানিতে ফেলে, তাদের ‘গণধোলাই দেওয়া উচিত’।
prothomasha.com
Copy Right 2023