সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পূর্ণ হচ্ছে আজ ১১ ফেব্রুয়ারি। এত বছরেও বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের কারণ জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র্যাব পাঁচ বছর আগে আদালতে জমা দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলেছিল, ঘটনাস্থলে দুজন অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএর নমুনা পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত সেই দুজনকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ ১০৫ বার পিছিয়েছে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি। সাগর সে সময় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টিভিতে এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। খুনের ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। খুনের দুই দিন পর পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহামুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে।
এদিকে ছয় দিন আগে ৫ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেন, ‘একটা জিনিস আমাদের লক্ষ করতে হবে, যাঁরা তদন্ত করেন, তাঁরা যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ইয়ে (রহস্য) উদ্ঘাটন না করতে পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তদন্ত শেষ করা সমীচীন হয় না। এই মামলার তদন্ত একটু কঠিন। তদন্তকারী সংস্থা সঠিকভাবে তদন্ত করে এ মামলার সুরাহা করবে। যাঁরা অপরাধী, তাঁদের অবশ্যই ধরা হবে।’সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছিলেন রুনির ভাই নওশের আলম। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন থেকে এ মামলার তদন্ত করছে র্যাব।
এক যুগেও খুনি ধরা না পড়ায় চরম হতাশ সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যত দিন সাগর-রুনির প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়বে না, তত দিন ওদের কবর দেখতে যাব না। কিন্তু আমি সেই প্রতিজ্ঞা বোধ হয় রাখতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘আমার বয়স (৭৩ বছর চলছে) হয়েছে। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। কখন কী হয় জানি না। তাই ভেবেছি, শিগগির সাগর-রুনির কবর জিয়ারত করতে যাব।’
আক্ষেপ করে সাগরের মা আরও বলেন, ‘অনেক খুনের মামলার জট খুলেছে সিআইডি (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ), পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ও র্যাব। আমি বিশ্বাস করি, খুনি যেখানেই পালিয়ে থাকুক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলেই সেটি বের করতে পারে। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে র্যাব সাগর-রুনির খুনিদের ধরতে পারছে না, সেটি আমার বোধগম্য হয় না।’ বিচার না দেখে দুই বছর আগে মারা গেছেন রুনির মা নূরণ নাহার মির্জা। খুনের সময় এই সাংবাদিক দম্পতির ছেলে মাহির সরওয়ারের (মেঘ) বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। সে এখন ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ লেভেলে পড়ে।
এক যুগের তদন্তে কী পেল র্যাব
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাহিরের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে। র্যাব আরও জানিয়েছিল, তখন ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ল্যাবে। ডিএনএ প্রতিবেদনে ঘটনাস্থলে অজ্ঞাত দুই পুরুষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
অবশ্য বিগত পাঁচ বছরে র্যাবের পক্ষ থেকে খুনের কারণ সম্পর্কে আদালতকে আর কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত বৃহস্পতিবার বলেন, সাংবাদিক সাগর ও রুনির খুনিদের শনাক্তের জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে র্যাব। ঘটনাস্থল থেকে ডিএনএর নমুনা পাওয়া অজ্ঞাত দুই পুরুষকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। প্রকৃত খুনিদের বিচারের আওতায় আনা হবে।আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের মধে৵ পাঁচজন অন্য একটি খুনের মামলার আসামি। তাঁদের বিরুদ্ধে চুরি ও ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে। তাঁরা এখনো কারাগারে। বাকি তিনজনের একজন রুনির পূর্বপরিচিত তানভীর আহমেদ, যিনি জামিনে রয়েছেন। ভাড়ার বাসাটির নিরাপত্তারক্ষী এনামুল কারাগারে এবং পলাশ রুদ্র পাল জামিনে রয়েছেন।সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে নৃশংসভাবে সাগর-রুনি খুন হয়ে গেলেন, অথচ খুনের প্রকৃত কারণ বের করা গেল না, সেটি অগ্রহণযোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘খুনিদের শনাক্ত না করা গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’
prothomasha.com
Copy Right 2023