বাবাকে সুস্থ করতে প্রাণপণ লড়েছিলেন মেয়েটি। দেশের কোনো চিকিৎসক যখন আশার কথা বলেননি, তখন বুকভরা আশা নিয়ে মেয়েটি ছুটে গিয়েছিলেন অন্য দেশে। অসুস্থ বাবার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘পাশে আছি।’ বাবাকে নিয়ে মেয়েটি শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরেছিলেন সত্যি, তবে প্রাণহীন। বাবাকে হারানোর পর মেয়েটি অদ্ভুত এক অবসাদে ডুবে যেতে থাকেন। মনে হতে থাকে, বাবার পাশে তিনি ঠিকঠাক থাকতে পারেননি। বাবাকে জীবিত অবস্থায় দেশে না ফেরাতে পারার অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। মেয়েটি একসময় নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেন। আশপাশের কারও কাছেই নিজের প্রশ্নগুলোর কোনো সদুত্তর তিনি পাচ্ছিলেন না। হয়তো তিনি মানসিকভাবে আরও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। ডুবে যেতেন বিষাদময় জগতে। সেই সময় একদিন তিনি বাবাকে স্বপ্ন দেখেন। বাবা স্বপ্নে এসে যেন মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। বলে যান, ‘সবকিছু আমাদের হাতে থাকে না। এটিই জীবনের নিয়ম।’ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা যা–ই হোক না কেন, এর পর থেকে মেয়েটি নিজেকে ধীরে ধীরে অবসাদ থেকে বের করে আনেন।
তবে সবাই কি আর অবসাদ থেকে বের হয়ে আসতে পারেন? আসলে জীবনের পথটি সব সময় মসৃণ থাকে না। হোঁচট খেতে হয়। চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়। কখনো পড়েও যেতে হয়। আর এই পড়ে যাওয়ার দায় কখনো আবার মাথায় তুলে নিতে হয়। কখনো নিজে থেকে, কখনো অন্য কেউ চাপিয়ে দেন বলে। তেমনই সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এক ব্যর্থতার গল্প বলি। মেয়েটির নাম মেঘনা (ছদ্মনাম)। মেঘনা উচ্চশিক্ষিত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। বাবাকে হারানোর পর নিজেই মাসহ পরিবারের সব দায়িত্ব সামলাতে শুরু করেন। ভালো গান গাইতে পারেন; কিন্তু একটি জায়গায় সমাজের চোখে মেঘনা ভীষণ ব্যর্থ। বয়স ৪০ হতে চললেও মেঘনার স্ট্যাটাস তখনো অবিবাহিত। কখনো মেঘনার পাত্র পছন্দ হয়নি; কখনোবা পাত্রপক্ষের মেঘনাকে। তবে অলিখিতভাবে সবাই যেন ধরেই নিয়েছেন—শ্যামবর্ণ, মোটাদাগে ‘কালো’ হওয়াতেই মেঘনার বিয়েতে এই বিপত্তি। বিয়ে না হওয়াই যেন মেঘনার জীবনের মস্ত ব্যর্থতা। শুরুতে প্রতিবাদ করলেও ধীরে ধীরে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যেতে থাকেন মেঘনা। কলেজে যাওয়ার সময়, এমনকি বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেও মুখে চড়া পাউডার বা মেকআপ মাখতে শুরু করেন। বিয়ের ব্যর্থতায় তাঁর অনেক সফলতাই ঢেকে যেতে থাকে। সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে থাকা মেঘনা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়তে থাকেন।
আসলে ঝলমলে রোদ্দুর এমনভাবে মেঘের আড়ালে চলে যায় আমাদেরই কিছু অসচেতনতার কারণে। সন্তানের অসুখ হলে, পড়াশোনায় খারাপ হলে, বিপথে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী করা হয় মাকেই। হয়তো কোনো স্বজন বলে ওঠেন, মা তো সারা দিন নিজের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। সন্তান মানুষ হবে কেমন করে। আর নিজের দিকে ওঠা এত আঙুল দেখতে দেখতে মা হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে বসেন, ‘সত্যিই কি আমি দায়ী?’ পেশাগত জীবনে দারুণ সম্ভাবনাময় মা হয়তো আবেগের বশে দুম করে চাকরিটাই ছেড়ে দেন। একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নেন। আসলে নিজেকে দোষী ভাবার এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। মনোবিদ বলছেন, আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণেই এমনটা ঘটে। এ জন্য ইতিবাচক চিন্তার বিকল্প নেই। অর্থাৎ নিজেকে প্রশ্নগুলো ‘না’–এর বদলে ‘হ্যাঁ’ দিয়ে করতে হবে। ‘আমি কী করিনি’, ‘আমার কী নেই’–এর বদলে ভাবতে হবে ‘আমি কী করেছি’, ‘আমার কী আছে।’
ফেরা যাক মেঘনার কথায়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল নিজেকে দোষারোপের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে মেঘনার সামনে দুটি পথ খুলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রথমত, এটা বুঝতে হবে—যাঁরা তাঁকে বিয়ে না হওয়ায় পুরোপুরি ব্যর্থ ভাবছেন, তাঁদের চিন্তায় ত্রুটি আছে। তাঁদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিজের গায়ের রং নিয়ে মনে গ্লানি না রেখে নিজের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। মেঘনাকে ভাবতে হবে—তিনি শিক্ষিত, স্বাবলম্বী, ভালো গান গাইতে পারেন। এগুলোকেই তাঁকে বড় করে দেখতে হবে। মনে গ্লানি এলে এসব ভাবনা এনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই মনোবিদের এমন পরামর্শ ভাবনার আরেকটি পথ দেখিয়ে দেয়। পরিবারের কোনো বিপর্যয়, সন্তানের অবাধ্যতা—এ সবকিছুর জন্য কখনোই কোনো মা একা দায়ী হতে পারেন না। অন্যের কথা শুনে আবেগপ্রবণ না হয়ে মায়েদের যুক্তিবাদী হওয়া প্রয়োজন। একজন মাকে ভাবতে হবে, সন্তানের যে সমস্যা হচ্ছে, সে জন্য কী কী বিষয় ভূমিকা রাখছে। সন্তানের বন্ধু, মানসিক অবস্থা বিবেচনা করেই তাঁকে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে খুব ইতিবাচক একটি উদাহরণ হতে পারে ২০২৩ সালে প্রচারিত নাটক অনন্যা। সন্তানকে কোথায় রেখে চাকরি করবেন, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবারের দোষারোপ, কর্মক্ষেত্রে তির্যক মন্তব্যে হতাশায় ডুবে যেতে যেতে মা অনন্যা চৌধুরী নিজেই দিবাযত্ন কেন্দ্র খোলেন। দেশজুড়ে ২০টি দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলেন তিনি। পুরস্কৃত হন। সফলতা পান। এই মা নিজেকে দোষারোপ করেননি। তিনি জানতেন, পারিপার্শ্বিকতার কারণেই তাঁর এমন পরিস্থিতি। আর তাই নিজেকে না বদলে তিনি চারপাশটা বদলানোর চেষ্টা করেছেন। এভাবেই নেতিবাচক চিন্তাকে দূরে ঠেলে ইতিবাচক চিন্তা করলে মেঘনারা আর মেঘে ঢেকে যাবেন না; বরং মেঘই রঙিন হয়ে রাঙিয়ে দেবে জীবনের আকাশ।
prothomasha.com
Copy Right 2023