ঈদুল আজহার বাকি এক মাসের কম। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মসলার আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক। বাজারে সরবরাহে তেমন ঘাটতি নেই। তবে শঙ্কা জাগাচ্ছে ডলারের দাম। কারণ, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময়মূল্য ১১০ থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ডলারের নতুন দামে শুল্কায়ন শুরু করলে আমদানি খরচ বাড়বে মসলার। তাতে ঈদের আগে বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
দেশের গরম মসলার বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। মসলা আমদানিতে করভার ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর মানে হলো, ১০০ টাকার মসলা আমদানিতে ৫৮ টাকা ৬০ পয়সা শুল্ক–কর দিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর বাড়ানোর কারণে কাস্টমসও ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন শুরু করছে। তাতে পণ্যের শুল্ক–করও বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে মসলা আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ফারুক আহমেদ বলেন, ঈদুল আজহায় যেসব মসলা ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। আগের তুলনায় এখন মসলার চাহিদা কম। ফলে নতুন করে মসলার দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু আমদানিতে শুল্কায়নের সময় ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়াতে শুরু করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এখন ঈদের আগে যদি ডলারের দর ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ১১৭ টাকা করা হয়, তাহলে আমদানি খরচ আরেক দফা বাড়বে। সে ক্ষেত্রে বাজারে প্রভাব পড়তে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, সার্বিকভাবে মসলার আমদানি কমলেও গরমমসলার সরবরাহ গতবারের তুলনায় বেশি। সাধারণত সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলে বাজারে দরদাম স্থিতিশীল থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত আদা, রসুন ও পেঁয়াজ ছাড়া সব ধরনের মসলা আমদানি হয়েছে ৭৬ হাজার ১৫৬ টন। ২০২৩ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৮৮ হাজার ৬২৩ টন। সার্বিকভাবে মসলার আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, জায়ফল, জয়ত্রী, জিরা, ধনে ও মসলার গুঁড়ার মোট আমদানি বেড়েছে। এসব মসলা গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৩১ হাজার ১৮৩ টন। এ বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৩৩ হাজার ২৮৩ টন। তবে একক পণ্য হিসেবে কিছু মসলার আমদানি কমেছে, কিছু মসলার আমদানি বেড়েছে।
মসলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লবঙ্গের সরবরাহ। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত লবঙ্গ আমদানি হয়েছিল ৭৭৭ টন। এবার তা ৬৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২৮৬ টন। বেড়েছে জিরা আমদানিও। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত জিরা আমদানি হয়েছে ১৩ হাজার ৪১৭ টন। এবার তা কিছুটা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৭৬০ টন। গোলমরিচের সরবরাহও বেড়েছে। এ বছর গোলমরিচ আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৩৩১ টন, গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৮৭০ টন।
তবে কমেছে এলাচিসহ কিছু মসলার আমদানি। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত এলাচি আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮১২ টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ৯০৭ টন। আমদানি কমেছে ৫ শতাংশ। দারুচিনি আমদানিও কমেছে। এ বছরের উল্লেখিত সময়ে এই মসলা আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৩০২ টন। গত বছর আমদানি ছিল ৭ হাজার ৩০৪ টন। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাজারের মসলা ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় মসলার চাহিদা কমেছে। নিত্যপণ্য না হলেও আগে মসলার বেচাকেনা ভালো ছিল।
পণ্য আমদানি হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত বিনিময়হার ধরে পণ্যের শুল্কায়িত মূল্য হিসাব করে। শুল্কায়িত মূল্য ধরে শুল্ক–কর হিসাব করা হয়। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক থেকে দৈনিক ভিত্তিতে প্রাপ্ত বিনিময় হারের মাসিক গড় হারের ভিত্তিতে ২৭টি দেশের মুদ্রার বাংলাদেশি টাকায় বিনিময় হার প্রকাশ করা হয়।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মে মাসের জন্য ডলারপ্রতি বিনিময় হার নির্ধারণ করেছিল ১১০ টাকা। তবে ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারে ডলারের দাম ১১০ থেকে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে। এরপর ১২ মে ডলারের বিনিময়হার সংশোধন করে ১১১ টাকা নির্ধারণ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ডলারপ্রতি এক টাকা বিনিময়মূল্য বাড়ার অর্থ হলো, শুল্ক–করও বাড়বে। ডলারের দর ঈদের আগে আরেক দফা বাড়তে পারে।
কোরবানির ঈদে ক্রেতাদের চাহিদার তালিকায় প্রধান মসলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এলাচি, জিরা, লবঙ্গ, গোলমরিচ ও দারুচিনি। এসব মসলার মধ্যে বাজারে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ার তালিকায় শুরুতেই রয়েছে এলাচি। বর্তমানে পাইকারি বাজারে এই মসলার কেজি ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। গত বছর ঈদুল আজহার এক মাসে আগে (মে মাসে) প্রতি কেজি এলাচি বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায়।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের সোনা মিয়া মার্কেটকেন্দ্রিক কয়েকজন ব্যবসায়ী ‘স্লিপ’ বেচাকেনার মাধ্যমে পণ্যটির দাম বাড়াচ্ছেন। এসব ব্যবসায়ী পেশাদার নন, তাঁরা আগে তেল ও চিনির এসও (সরবরাহ আদেশ) বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে সেখানে বর্তমানে ব্যবসা মন্দা হওয়ায় তাঁরা এলাচির ব্যবসায় ঢুকে পড়েছেন। তাতে এলাচির দাম হঠাৎই কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে।
এলাচির মতো জিরার দামও এখন চড়া। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জিরার দাম। ২০২০ সালে পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রতি কেজি জিরার দাম ছিল ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। ২০২৩ সালে এক লাফে ৯৫ শতাংশ বেড়ে জিরার দাম উঠে যায় সর্বোচ্চ ৮৬০ টাকা পর্যন্ত। চলতি বছরেও দাম ৬৫০ থেকে ৮৫০ টাকার ঘরে।
জিরা ও এলাচি ছাড়া অন্য কয়েকটি মসলা পণ্যের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে ধনের দাম ১১ শতাংশ ও দারুচিনির দাম ৯ শতাংশ বেড়েছে। লবঙ্গ ও গোলমরিচের দামও কিছুটা বেড়েছে। গত বছর ঈদুল আজহার আগে বাজারে প্রতি কেজি ধনের দাম ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর দারুচিনির দাম ছিল ৩০০ থেকে ৩৭০ টাকা কেজি। তবে বছর ঘুরতেই প্রতি কেজি ধনে বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ৩০০ টাকায় ও দারুচিনি ৩৭০ থেকে ৪৩৫ টাকায়। বাজারে প্রতি কেজি লবঙ্গ সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০০ ও গোলমরিচ ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পাইকারি গরমমসলা ব্যবসায়ী সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অমর কান্তি দাশ বলেন, ঈদের মসলার দাম বাড়ার আশঙ্কা কম। তবে রপ্তানিকারক দেশে দাম বাড়লে সে ক্ষেত্রে দেশেও দাম বাড়তে পারে। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক লোকসানসহ নানা কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারিয়েছেন আমদানিকারকেরা।
prothomasha.com
Copy Right 2023