আজ রাতে রিয়াল মাদ্রিদের সাদা বাসটির সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রবেশ করার দৃশ্যটা নিশ্চয় এড়িয়ে যেতে চাইবেন বায়ার্ন মিউনিখ সমর্থকেরা। ভুলে যেতে চাইবেন, ম্যাচটি তাঁরা কোথায় খেলছেন, সেটাও। একই সঙ্গে প্রার্থনা করবেন, দলের খেলোয়াড়েরাও যেন কয়েক ঘণ্টার জন্য ভুলে যান সব। রিয়ালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যেতে হলে এ ছাড়া আর উপায় কী! রিয়ালের মাঠ মানেই বায়ার্নের ‘মৃত্যু’, নয়তো ‘আত্মহত্যা’! প্রায় দুই যুগ ধরে চিত্রটা এমনই।
এমনিতেই লোকে বলে, ইউরোপে মৃত্যু আসে সাদা বাসে চড়ে। ইউরোপিয়ান ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদ কতটা ভয়ংকর দল, সেটি বোঝাতেই বলতে শোনা যায় এ কথা। কিন্তু বায়ার্ন মিউনিখের জন্য কথাটি মনে হয় একটু বেশিই সত্যি। এক দশক ধরে সাদা বাসে চড়ে আসা কিছু লোক ১৮০ মিনিটের লড়াইয়ে বায়ার্নের চ্যাম্পিয়নস লিগ স্বপ্নের কবর রচনা করে গেছে বারবার। আর লড়াইটা যদি বার্নাব্যুতে হয়, তবে তো কথাই নেই!
২০০০ সালের পর বার্নাব্যুতে ৭ ম্যাচ খেলে জয়ের খাতাটায় পড়ে আছে বিশাল এক শূন্য। এমনকি বায়ার্নের মিডফিল্ডের প্রাণভোমরা জামাল মুসিয়ালা পৃথিবীর আলোয় আসার পর কখনো বার্নাব্যুতে বাভারিয়ানদের জয় দেখেননি। তবে ইতিহাসেরও শেষ আছে, আছে নক্ষত্রেরও পতন। ইতিহাসের সেই একরৈখিক ধারাটা বদলানোর আজ দারুণ এক সুযোগ বায়ার্নের সামনে। কাজ তেমন কঠিন কিছু নয়, রিয়ালের মাঠে ন্যূনতম ব্যবধানের একটি জয়!
‘কাজ তেমন কঠিন কিছু নয়’—এটুকু শুনে প্রকৃতিও হয়তো অলক্ষ্যে হাসছে! এই ‘সহজ’ কাজটি করতে গিয়ে কত দল যে মানজানারেসের তীরে এসে ডুবেছে, তার হিসাব মেলা ভার। খোদ বায়ার্নের ডোবার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এরপরও কাজটি যদি কেউ শেষ পর্যন্ত করতে পারে, সেটি সবচেয়ে বেশি সম্ভব এই বায়ার্নকে দিয়েই। কাগজে-কলমে ইউরোপের দ্বিতীয় সফল দল। যারা জানে বড় মঞ্চে কীভাবে জিততে হয়।
গত দুই দশকের হিসাব ভুলে গেলে পরিসংখ্যানটা খুব মন্দও নয়। ২৭ ম্যাচে রিয়ালের ১২ জয়ের বিপরীতে নিজেদের ১১ জয়। এবার সুযোগ এক ঢিলে অনেক পাখি মারার। আজ রাতে রিয়ালকে হারাতে পারলে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠার পাশাপাশি রিয়াল-ডেডলকও ভাঙতে পারবে বায়ার্ন। সর্বশেষ ৮ দেখায় যে রিয়ালকে হারাতেই পারেনি তারা। উল্টো এই ৮ ম্যাচের ৬টিতেই হেরেছে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনার দলটি।
রিয়ালের বিপক্ষে আজ রাতে ২-২ গোলের সমতা নিয়ে মাঠে নামবে বায়ার্ন। টমাস টুখেলকে আজকের লড়াইটা জিততে হবে মাঠে নামার আগেই। অর্থাৎ টুখেলের কৌশলের ওপর নির্ভর করছে বায়ার্নের বাঁচা-মরার অনেকটাই। প্রথম লেগের কথাই ধরা যাক। ম্যাচের ২৪ মিনিট পর্যন্ত বলটাকে যেন অচ্ছুত করে রেখেছিলেন রিয়ালের খেলোয়াড়েরা। বলের কাছেই পৌঁছাতে পারছিল না। তবে কে না জানে, রিয়াল যখন কোথাও থাকে না, তখনো তারা বেশি বিপজ্জনক! আপনি যে বুঝতেই পারবেন না আঘাতটা কোন দিক থেকে আসছে! সেদিনও তেমন এক মুহূর্তে বায়ার্নের চার খেলোয়াড়ের কাছ থেকে গার্ড অব অনার আদায় করে ভিনিসিয়ুসকে অবিশ্বাস্য এক গোল বানিয়ে দেন টনি ক্রুস। এই ১ গোল, ২৪ মিনিট ধরে ম্যাচে রিয়ালের নিয়ন্ত্রণ না থাকাকেই যেন প্রহসন বানিয়ে দেয়।
সেদিন অবশ্য শুরুতে গোল খাওয়ার ধাক্কা সামলে বায়ার্ন ম্যাচে লিডও নিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সে লিড ধরে রাখতে পারেনি তারা, সন্তুষ্ট থাকতে হয় ড্র মেনে নিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে লিড নেওয়া এবং ম্যাচের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য টুখেলের কৌশলকে বিশেষ কৃতিত্ব দিতে হয়। বিরতির পর জামাল মুসিয়ালা ও লেরয় সানেকে প্রান্ত অদলবদল করে খেলায় তাঁদের কার্যকারিতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি লেওন গোরেৎজকার পরিবর্তে রাফায়েল গেরেরোর মাঠে নামাও বদলেছে ম্যাচের রূপ।
যা হওয়ার তা তো অবশ্য হয়ে গেছে। আজ নতুন একটি দিন, আর কার্লো আনচেলত্তি তো প্রতিদিনই নতুন। প্রতি ম্যাচেই ছোটখাটো কৌশলগত পরিবর্তন এনে প্রতিপক্ষ কোচদের রীতিমতো ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন এই ইতালিয়ান। আজ রাতের ম্যাচের আগেও বাতাসে ভাসছে তেমন কিছু প্রশ্ন। রিয়াল কি আজ বলের দখল রেখে খেলবে? বায়ার্ন যদি একই কৌশলে খেলে, তখন আনচেলত্তি কীভাবে দলকে খেলাবেন? গেরেরো ও কোমানের না থাকার সুযোগকে কীভাবে কাজে লাগাবেন আনচেলত্তি? এখন পর্যন্ত আনচেলত্তির কৌশলকে বিশ্লেষণ করলে এর উত্তর পাওয়া একটু কঠিনই। কারণ, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী দলকে পরিচালনা করছেন বর্ষীয়ান এই কোচ।
কোচ হিসেবে আনচেলত্তি ও টুখেল পুরোপুরি একে অন্যের বিপরীত। যেভাবে তাঁরা ডাগআউটে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, সংবাদ সম্মেলনে নিজের খেলোয়াড়দের নিয়ে কথা বলেন এবং যেভাবে খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করেন, তা একেবারেই আলাদা। ডাগআউটে উত্তেজনায় ফেটে পড়া মুহূর্তটিতেও আনচেলত্তির আবেগের সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে চুইংগাম চিবাতে চিবাতে চোয়াল কাঁপাতে থাকা এবং ভ্রু কুঁচকে রাখা।
আর যখন ম্যাচ যখন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কিংবা পুরোপুরি ফসকে যাচ্ছে, তখনো তাঁর মুখে দেখা যায় সেই একই অভিব্যক্তি। যে কোচের ভালো লাগা বা মন্দ লাগার অভিব্যক্তিকেই আলাদা করা যায় না, তাঁকে কৌশলে পরাস্ত করা কঠিনই হওয়ার কথা। অন্যদিকে টুখেল আবেগে ভরপুর এক কোচ। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে উৎসাহ ও সমালোচনা—দুটোই সমানে চলে তাঁর। এমনকি ম্যাচ শেষে নিজের খেলোয়াড়কে ‘লোভী’ বলতেও বাধে না তাঁর।
একেবারে বিপরীতমুখী হলেও মাঠে নিজেদের কৌশল প্রয়োগে কিছু সাদৃশ্যও রয়েছে তাঁদের। দুজনের কেউই কৌশল নিয়ে গোঁড়ামিতে ভোগেন না। পেপ গার্দিওলা যেমন ম্যাচের যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের কৌশল আঁকড়ে ধরে রাখতে চান, এই দুজন কিন্তু তেমন নন। জেতার জন্য নিজেদের আমূল বদলে ফেলতেও দ্বিধা নেই এই দুজনের। প্রথম লেগে রিয়াল শুরু থেকে বায়ার্নের পায়ে বল তুলে দিয়ে অপেক্ষা করে গেছে সঠিক মুহূর্তের।
কিন্তু দ্বিতীয় লেগেই হয়তো উল্টে যেতে পারে এ চিত্র। এবার হয়তো রিয়ালকে বলের দখল রাখতে দিয়ে বায়ার্ন চেষ্টা করবে প্রতি-আক্রমণ থেকে সুযোগ তৈরির। কিংবা রিয়ালের বক্স ওভারলোড করে শুরু থেকে চাপ তৈরির চেষ্টাও করতে পারেন টুখেল। আনচেলত্তিও অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। মিডফিল্ড ও আক্রমণভাগে দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় আছে তাঁরও। চাইলে একই কাজের পুনরাবৃত্তি তিনিও করতে পারেন। কিংবা আনচেলত্তি হয়তো এ ম্যাচে মাঝমাঠ ধরে আক্রমণে গিয়ে ধসিয়ে দিতে চাইতে পারেন বায়ার্নকে। তবে ম্যাচটা জমে উঠবে যদি দুজনই একই কৌশলে দলকে খেলাতে চান। তেমনটি হলে মাঝমাঠের লড়াই এই ম্যাচকে ধ্রুপদি করে তুলতে পারে।
ম্যাচের শুরুতে দুই দলের কৌশল অবশ্য যেমনই থাকুক, শেষ পর্যন্ত যে এটি একই রকম থাকবে না। পিছিয়ে পড়া দল নিশ্চিতভাবে কৌশল বদলে নিজেদের ‘প্ল্যান বি’ সচল করবে। যেমনটা প্রথম লেগে বিরতির পর টুখেল করেছিলেন। বার্নাব্যুতে যদি বায়ার্ন লিড নেয়, সে ক্ষেত্রে কৌশলের পরিবর্তন আনতে পারেন আনচেলত্তিও। তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের এই মানসিকতায় মূলত দুই কোচকে মিলিয়ে দিচ্ছে একই বিন্দুতে। তবে কৌশল, পরিকল্পনা বা রূপরেখা যা–ই হোক, ইউরোপিয়ান ক্লাসিকোর এই লড়াইয়ে জয়ই হচ্ছে শেষ কথা। আর যেকোনো মূল্যে জেতার মানিসকতার কারণে এই ম্যাচ হয়ে উঠতে পারে ‘ব্যাটল অব দ্য সিজন’-এ।
prothomasha.com
Copy Right 2023