আমরা যখন ঘুমাই, আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু তখন ঘুমায় না। রাতে ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নেয়। সেটা হলো সারা দিনে লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করা এবং সেসব মস্তিষ্কে মেমোরি বা স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা। স্মৃতি কীভাবে তৈরি হয়? এর তিনটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপটি হলো ‘ইকুইজিশন’ বা অধিগ্রহণ। মানে নতুন কিছু শেখা বা নতুন কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া। দ্বিতীয় ধাপটি হল ‘কনসোলিডেশন’ বা একত্র করা। অর্থাৎ নতুন শেখা জিনিসটাকে মস্তিষ্কে সুস্থিত করা। শেষ ধাপটি হলো ‘রিকল’ বা মনে রাখা। এর অর্থ এই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাকে মস্তিষ্কে এমনভাবে সংরক্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যতে এটি মনে করে কাজে লাগানো যায়।
এই প্রক্রিয়ার প্রথম দুটি ধাপ ইকুইজিশন ও কনসোলিডেশন ঘটে যখন আমরা জেগে থাকি, তখন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রিকল করা বা স্মৃতিতে রূপান্তরিত করার কাজটি হয় ঘুমের মধ্যে। মস্তিষ্কের হিপোক্যামপাস এবং নিওকর্টেক্স এলাকা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, রাতে ঘুমের মধ্যে হিপোক্যাম্পাস দিনের সব ঘটনা নিওকর্টেক্সের কাছে রিপ্লে বা পুনঃসম্প্রচার করতে থাকে, আর নিওকর্টেক্স একে প্রক্রিয়াজাত করে স্মৃতিতে রূপান্তরিত করে। অনেকটা রিভিশনের মতো ব্যাপারটা।
তাই যদি কেউ পর্যাপ্ত না ঘুমায়, তাহলে দিনে জেগে থাকার সময় যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তা পরবর্তী সময়ে কোনো কাজে না–ও আসতে পারে। ধরা যাক, কেউ পরীক্ষার আগের দিন রাত দুটো পর্যন্ত জেগে কিছু একটা পড়েছেন। কিন্তু পরদিন পরীক্ষার হলে গিয়ে সেটা কিছুতেই মনে পড়ছেন না, সব ঝাপসা মনে হচ্ছে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কারণ, ওই জ্ঞান স্মৃতি বা মেমোরিতে সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় মস্তিষ্ক পায়নি।
এ ছাড়া পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মস্তিষ্ক ধোঁয়াশাময় (ফগি) হয়ে আসে, মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে এবং একটা বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ করা যায় না কিছুতেই। ঘুমের অভাব আমাদের বিচার–বিবেচনা ও সূক্ষ্ম দক্ষতাকেও প্রভাবিত করে। এ ছাড়া রাতের পর রাত না ঘুমালে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে বলে প্রমাণিত। সে জন্য গবেষকেরা বলেন, রাতে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম দরকার। সামনে পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ থাকলেও এর ব্যতিক্রম চলবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, রাত জেগে পড়ে দিনের বেলা ঘুমিয়ে কি সেটা পূরণ করা সম্ভব? বিজ্ঞানীরা একমত নন। কারণ, মানবদেহ আদিমকাল থেকে যে নিয়মে চলে, তাতে বেশির ভাগ হরমোন, যেমন কর্টিসোল, থাইরক্সিন, অ্যাড্র্রিনালিন এবং নানা ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার দিনের প্রথমভাগেই বেশি নিঃসরিত হয়। রাতে এসবের মাত্রা একেবারে তলানিতে নেমে আসে। তাই রাত জাগলে দেহের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ রাত জেগে করা কাজ বা পড়া আমাদের খুব একটা কাজে আসে না। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে রাত জেগে পড়া, টিভি দেখা, মুঠোফোনে কথা বলা ইত্যাদি আর নয়। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হলে রাতে অন্তত ছয়–সাত ঘণ্টা ঘুমাতে হবেই। নয়তো স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।