টাকার অভাবে বিদ্যুৎ ও সারের পাওনা মেটাতে ব্যাংকগুলোকে বন্ড দিচ্ছে সরকার। আর ব্যাংকগুলো এই বন্ড জমা রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে। আর্থিক সংকটে থাকা সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক একসময় টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিত। তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সে পথ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরে আসে। এখন সরকার দেনা মেটাতে বন্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। সেই বন্ডের বিপরীতে টাকা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বাড়ছে মুদ্রা সরবরাহ।
অন্যদিকে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে ঘরে রাখার প্রবণতা আবার বেড়েছে। গত মার্চ মাসে গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এসব টাকা ওই মাসে আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি। ফলে এই টাকা রয়ে গেছে মানুষের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এরপরের মাসগুলোতে মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যাংকের বাইরে আরও বেশি পরিমাণ টাকা চলে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমে আসছিল। তবে বন্ডের বিপরীতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম ও একীভূত করার উদ্যোগে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বাড়ছে।
মুদ্রা সরবরাহ কতটা বাড়ল
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। নভেম্বর মাসে যা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসেই ছাপানো টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ছাপানো টাকার বড় অংশ থাকে মানুষের হাতে ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে। বাকি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা থাকে।
ডিসেম্বরে মুদ্রা সরবরাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সংকটে পড়া ইসলামি ও প্রচলিত ধারার সাতটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে এক দিনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই বেড়ে যায় মুদ্রা সরবরাহ। সেই টাকা ফেরত আসায় জানুয়ারিতে রিজার্ভ মানি বা মুদ্রা সরবরাহ কমে হয় ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। তবে ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে হয় ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। গত মার্চে মুদ্রা সরবরাহ আরও বেড়ে হয় ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বিদ্যুৎ ও সারের পাওনা মেটাতে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে সরকার। এর প্রায় পুরোটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়ে ১৮০ দিন মেয়াদে সমপরিমাণ টাকা নিয়েছে ব্যাংকগুলো। এর মেয়াদ শেষ হলে বন্ডের মেয়াদ থাকা পর্যন্ত আবারও ১৮০ দিনের জন্য টাকা নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। সরকারের ইস্যু করা বন্ডের মেয়াদ ৮-১০ বছর। মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মার্চ পর্যন্ত যে মুদ্রা সরবরাহ হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণের মধ্যে রয়েছে।
মানুষ হাতে রাখছে টাকা
মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের হাতে নগদ টাকা বাড়ছে। অর্থাৎ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখছে। জানুয়ারিতে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যা ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা বেড়ে হয় ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। মার্চে নগদ অর্থের পরিমাণ আরও বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। ফলে শুধু মার্চ মাসেই মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর যা আর ব্যাংকে জমা হয় না, তা-ই ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই টাকা মানুষ হয় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে, নয়তো বেশি লাভের আশায় ব্যাংকের বাইরে বিভিন্ন সমিতি, জমি, ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করেন। আবার কেউ কেউ টাকা তুলে ঘরেও রেখে দেন।
বেশির ভাগ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে কথা বলতে চান না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এমডি বলেন, নির্বাচনের আগে গত ডিসেম্বর মাসে নগদ টাকার লেনদেন বেড়ে যায়। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষ সঞ্চয় ভাঙাচ্ছেন। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে আতঙ্কিত হয়েও অনেকে টাকা তুলে ফেলছেন। এ কারণে অনেক ব্যাংক তারল্য–সংকটে পড়ে গেছে। তবে এসব অর্থ কিছুদিন পর আবার বিভিন্ন হাত ঘুরে ব্যাংকে ফিরে আসবে। সুদ বাড়লেও আমানতের গতি কম
ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে যে সীমা টেনে দেওয়া হয়েছিল, গত জুলাইয়ে তা তুলে নেওয়া হয়। এরপর প্রতি ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের ভিত্তিতে ‘স্মার্ট’ সুদহার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি মাসে সুদহার বাজারভিত্তিক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশের আশপাশে। ব্যাংকগুলো আমানতেরও সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত জমা নিচ্ছে। আবার কোনো ব্যাংকের আমানতের সুদহার ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এদিকে সরকারও ১২ শতাংশের বেশি সুদে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করছে। ফলে ব্যাংকগুলোকে আমানতের ওপর বেশি সুদ দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক ব্যাংকার।
তবে সুদ বাড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কোনো কোনো ব্যাংক যে পরিমাণ নতুন আমানত পাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আমানত তুলে ফেলছেন গ্রাহকেরা। গত মার্চে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ, তবে ওই সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশের বেশি। আবার ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কেনার কারণেও ব্যাংক খাতে টাকার টান পড়েছে। পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে তারল্যসংকটে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ সংকট সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ধারার দুটি ও শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকে। এক বছরের বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে এসব ব্যাংক। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় এসব ব্যাংকের লেনদেন চালু রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।