চট্টগ্রামের আনোয়ারার উপজেলা সদরের সাত কিলোমিটার দূরে নিরিবিলি গ্রাম পরৈকোড়া। গ্রামের খেত-খামার আর গাছগাছালির নিবিড় সখ্যের মাঝখানে অনুপম সৌধের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি অর্ধবৃত্তাকার খিলানাকৃতির প্রবেশ দ্বার। তোরণটির মাথায় বট-অশ্বত্থ আর আগাছার ঝোপ যেন মুকুটের মতো শোভা পাচ্ছে। সেদিক দিয়ে ভেতরে গেলেই এককালের সাতমহলা রাজবাড়ি। তবে এখন প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে কঙ্কাল দেখে যেমন মানুষের অবয়ব শনাক্ত করা যায়, তেমনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া কাঠামো দেখেই অনুমান করা যায় বাড়িটির অতীতের জৌলুশ। কেবল বৈঠকখানা, শানবাঁধানো পুকুরঘাট, মন্দির কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লাল ইট বিছানো আঙিনায় এসে দাঁড়ালে কেমন গা ছমছম করে ওঠে। এই বাড়িতেই একসময় প্রতিদিন সুরের মূর্ছনা আর বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার শোনা যেত। ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী ও গায়িকা কানন দেবীও প্রসন্ন কুমারের বাড়িতে এসেছিলেন দলবল নিয়ে। গ্রামের প্রবীণেরা সেসব কথা ভেবে এখনো বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
ব্রিটিশ শাসনামলের জমিদার রায় বাহাদুর প্রসন্ন কুমার ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনা। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় পরৈকোড়ায় সারা বছর লেগেই থাকত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পরবর্তী সময়ে তাঁর উত্তরসূরিরাও সে ধারা বজায় রাখেন। প্রসন্ন কুমারের সেই বাড়ি এখন কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। শোনা যায়, আনোয়ারা ছাড়িয়ে মহেশখালী পর্যন্ত প্রসন্ন কুমারের জমিদারি বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সব হারিয়ে গেছে।
প্রসন্ন কুমারের বাড়িতে যে ভারতের বিখ্যাত শিল্পীদের পা পড়েছে, তা এলাকার প্রবীণেরা জানেন। ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন সম্পাদিত ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ বইতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ওই বইতে লেখা আছে, ‘জমিদার রায় বাহাদুর প্রসন্ন কুমারের ভ্রাতুষ্পুত্র সুজিত রায়ের আমন্ত্রণে ভারতের চিত্রনায়িকা কানন বালা দেবী তাঁর সাংস্কৃতিক দল নিয়ে এক মাস অনুষ্ঠান করেন এই বাড়ির নাচখানায়। এমনকি একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন সেখানে থাকার সময়।’
জমিদার প্রসন্ন কুমারের মূল বসতবাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেলেও বাড়ির পূর্বদিকে অবস্থিত সুদৃশ্য ফটক জানান দেয় পুরোনো জৌলুশের। একসময় এই ফটকের ওপর বাঘ ও হরিণের মূর্তি থাকলেও বর্তমানে নেই। ভিটায় প্রবেশের পর বাড়ির ডানপাশেই চোখে পড়বে একটি মন্দির। ওই মন্দিরে এখনো স্থানীয় লোকজন পূজা দেন।
বাড়ির বৈঠকখানার একটি অংশ এখনো টিকে আছে। সেখানে দেখা হয় জমিদার প্রসন্ন কুমারের বংশধর অমৃত কুমার রায়ের স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব পূরবী রায়ের সঙ্গে। বৈঠকখানায় একাই থাকেন তিনি। পূরবী রায় বলেন, ‘প্রায়ই এখানে বিভিন্ন পেশার মানুষজন আসেন। তাঁরা আমার কাছ থেকে জমিদারি সম্পর্কে জানতে চান। আমি যতটুকু জানি, তা তাঁদের বলি।’
পূরবী রায় আরও বলেন, ‘স্বামীর পূর্বপুরুষেরা জমিদার ছিল, এ কথা ভেবে ভালো লাগে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও সম্মান করেন। আমাদের সম্পত্তিগুলো দেবোত্তর হওয়ায় বিক্রি করা যায় না। তাই এখানে থাকতে হচ্ছে। আমার স্বামী মারা গেছেন ২৩ বছর আগে। দুই মেয়ে ছিল, তাদের বিয়ে হয়েছে। জমিদারি অনেক নিদর্শন শহরের বাসায় আছে।’
পূরবী রায় ছাড়া ঘরে কেউ না থাকায় তাঁর অনুমতি নিয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলে চোখে পড়ে জমিদার প্রসন্ন কুমারের শৌখিনতার। পুরো বৈঠকখানার মেঝেতে অপূর্ব কারুকার্যখচিত টাইলস বসানো। তবে এখানে কিছু কিছু টাইলস ভেঙে যাচ্ছে। খসে পড়ছে চুন-সুরকি। বড় দেয়ালে আঁকা আছে বিভিন্ন নকশা। পূরবী রায় এ সময় বৈঠকখানার পাশে শানবাঁধানো পুকুরঘাটটিও দেখান।
জানা যায়, পরৈকোড়া গ্রামে ১৮৯৭ সালের দিকে রায়বাহাদুর প্রসন্ন কুমার এলাকার শিক্ষা বিস্তারে চালু করেন মধ্যম ইংরেজি স্কুল। পরবর্তী সময়ে সেটি তাঁর উত্তরসূরিদের পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চবিদ্যালয়ে রূপ নেয়। এমনকি গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ২৫ মাইল সড়কে ইট বসিয়ে দেন প্রসন্ন কুমারের ছোট ভাই ক্ষীরোদ চন্দ্র রায় বাহাদুর। তিনি তৎকালীন জেলা বোর্ডের সচিব ছিলেন।
আনোয়ারার পরৈকোড়াই নয়, মহেশখালীতেও বিরাট জমিদারি ছিল প্রসন্ন কুমারের। মহেশখালী সদরে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর জমিদারবাড়ি। আনোয়ারার পুরোনো বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে এখন যা আছে, তা–ও একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন গ্রামবাসী।
prothomasha.com
Copy Right 2023