Skip to content

যুবলীগ নেতার ছত্রছায়ায় মিরপুরের ‘মাদকের রানী’

    যুবলীগ নেতার ছত্রছায়ায় মিরপুরের ‘মাদকের রানী’ prothomasha.com

    পেশা তো একটা থাকতেই হয়, না থাকলে সংসারের চাকা ঘুরবে কী করে। তবে কেউ বৈধ পথে, আবার কেউ অবৈধভাবে টাকা রোজগার করে। তেমনই একজন ফাতেমা বেগম ফতে। তার বৈধ কোনো পেশা নেই। ফতে রাজধানীর মিরপুরের ‘মাদকের রানী’। বছরখানেক আগে মারা যাওয়া স্বামী দুলাল মোল্লাও একই এলাকার বড় মাপের মাদক কারবারি ছিল। মাদক কারবারের টাকায় এ দম্পতি শাহআলী এলাকায় দুটি বাড়ি কিনেছে।

    গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে নির্মাণ করেছিল আলিশান বাড়ি, কিনেছিল বিঘা বিঘা জমি। তবে বছর দুয়েক আগে সেসব সম্পদ অজানা কারণে বাজারদরের চেয়ে কম দামে বেচে দেয়। তবু বিক্রীত সম্পদের দাম পেয়েছে কোটি টাকার ওপরে। অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে সমকাল। জানা গেছে, দুলাল-ফতে দম্পতি নব্বই দশকে বাস করত মিরপুরের ঢাকা কমার্স কলেজের অদূরে হাজি রোডের ঝিলপাড় বস্তির খুপরি ঘরে।

    স্বামীর হাত ধরে গাঁজার কারবারে নাম লেখায় ফতে। ধীরে ধীরে ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা কারবারেও জড়িয়ে পড়ে। তাদের বড় ছেলে জয়ও পৈতৃক সূত্রে মাদক কারবারি। এক-দুটি নয়, একাধিক মাদক মামলার আসামি তারা। শাহআলী থানায় জয়ের নামে রয়েছে পাঁচ মামলা। আর ফতের নামে মামলার সংখ্যা ১১। এর মধ্যে ২০১২ সালের দুটি, ২০১৫ সালের একটি, ২০১৯ সালের একটি, ২০২০ সালের দুটি ও ২০২১ সালের পাঁচটি মাদক মামলার তথ্য মিলেছে। তবে শাহআলী থানা পুলিশ বলছে, ফতের মামলার সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তার স্বামী দুলালের বিরুদ্ধেও একাধিক মাদক মামলা ছিল।

    জানা গেছে, যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ৯৩ নম্বর ওয়ার্ডের (শাহআলী এলাকা) সভাপতি সোয়েব আলী শিকদারের ছত্রছায়ায় ফতের মাদক কারবারের বিস্তার বলে অভিযোগ রয়েছে। ফতের ছেলে জয়ের সঙ্গেও রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। এ ব্যাপারে সোয়েব আলী বলেন, ‘ওই এলাকায় আমার বাসা। তবে আমি থাকি এফ ব্লকে। ওই ধান্ধা এলাকায় আমি যাই না। আমার বিষয়ে অভিযোগ ঠিক নয়।’

    চিহ্নিত মাদক কারবারি ও একাধিক মামলার আসামি হওয়ার পরও ফতের ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেন হেলদোল নেই। শাহআলী থানার অদূরেই তার বাসা। তাকে গ্রেপ্তার ও মাদক কারবার বন্ধে দীর্ঘদিন পুলিশের দৃশ্যমান কোনো অভিযান দেখেননি এলাকার মানুষ। সবশেষ ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ১ হাজার ১৫ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল ফতে। তবে কয়েক মাসের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে একই পেশায় ফেরে। এর পর থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার ছেলে জয় ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে সেও জামিনে বের হয়।

    শাহআলী থানার ওসি মওদুত হাওলাদার জানান, তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে মাদক মামলা রয়েছে। তারা এ এলাকায় থাকলেও গোপনে চলাফেরা করে। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা উত্তর বিভাগের মিরপুর সার্কেলে গত ১০ বছরে যারা পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন, তারাও গ্রেপ্তার করেননি ফতেকে। বর্তমানে মিরপুর সার্কেলের দায়িত্বরত পরিদর্শক সাইফুল ইসলামের কাছে ফতের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ফতে আত্মগোপনে আছে। ২০১৬ সালের দিকে ডিএনসির পরিদর্শক খন্দকার ইকবাল মিরপুর সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ফতে বড় মাদক কারবারি। তবে তাকে গ্রেপ্তার করেছিলাম কিনা মনে নেই।

    ঢাকায় দুই বাড়ি

    মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের রাইনখোলা ঢাল থেকে শাহআলী থানার দিকের সড়কে যেতেই বাঁ পাশে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের সীমানাপ্রাচীরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে বাঁ দিকে নিউসি ব্লকে ঢোকার একটি রাস্তা চলে গেছে। এ রাস্তা ধরে আনুমানিক ৫০ গজ হাঁটলেই বাঁ দিকে ১৬ নম্বর রোড। এটি ধরে ২০ গজ গেলে ডান পাশে ১৭ নম্বর রোডের কটি কানাগলি। এ গলির ২২ নম্বর হোল্ডিংয়ের পাঁচতলা বাড়িতে বাস করে ফতে। ২০০৬ সালের দিকে বাড়িটি যখন কিনেছিল, তখন ছিল টিনশেড। পরে সেটি পাঁচতলা করা হয়। এ গলিতেই রয়েছে তিনতলা আরেকটি বাড়ি। হোল্ডিং নম্বর ৬। এটি প্রায় কোটি টাকা দিয়ে কিনেছে বছরখানেক আগে। এখন নিউসি ব্লকের ২০ নম্বর রোডের আরেকটি বাড়ি কেনার কথাবার্তা চলছে।

    গ্রামেও কেনে প্রচুর জমি

    নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চর কামালদি। ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীর সঙ্গে দুলাল-ফতের বিষয়ে কথা হয়। তারা জানান, গ্রামের বাসিন্দারাও ঢাকায় তাদের মাদক কারবারের বিষয়ে জানেন। গ্রামের বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত ছিল দুলালের। অবশ্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, যেন ইউনিয়ন এলাকায় মাদক সরবরাহ না করে। দুলাল একবার ইউপি মেম্বার পদে নির্বাচন করে হেরেছিল।এলাকাবাসী আরও জানান, দুলাল এলাকায় প্রচুর জমি কিনেছিল। দেখার মতো বাড়িও করেছিল। বছর দুয়েক আগে বাড়িসহ সব জমি কোটি টাকার ওপরে বিক্রি করে দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিয়ন পরিষদের এক জনপ্রতিনিধি জানান, সম্পত্তি অনেক কম দামে বিক্রি করেছে দুলালরা। দুই কোটি টাকার ওপরে দাম ছিল। কেন তাড়াহুড়া করে এসব সম্পত্তি বিক্রি করা হয়েছে, তা জানে না কেউ।

    বস্তিতে গাঁজা দিয়ে শুরু

    দুলাল ৯০ দশকে ঝিলপাড় বস্তির খুপরি ঘরে থাকত। কিশোর বয়স থেকে ছিল মাদকাসক্ত। কোনো কাজ করত না। বস্তিতে গাঁজার পুরিয়া বিক্রি করত। ৯০ দশকের মাঝামাঝি দুলাল-ফতের বিয়ে হয়। এরপর স্বামীর সঙ্গে গাঁজার কারবারে নামে। গাঁজার পাশাপাশি আস্তে আস্তে ফেনসিডিল, হেরোইন বিক্রি শুরু করে। বস্তির কয়েকজন বৃদ্ধ সমকালকে জানান, দুলালের কাজই ছিল মাদক বিক্রি। মাদকের টাকায় বস্তিতে বেশ কয়েকটি টিনের ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছিল। কয়েকটি ঘরে মাদকের আড্ডা বসানো হতো। সেখানেও বেচাকেনা চলত।

    বস্তি ছাড়ে দেড় যুগ আগে

    বস্তিতে থাকতেই মাদক কারবারি হিসেবে এলাকায় চিহ্নিত হয় তারা। অল্প সময়ে বিপুল টাকা কামিয়ে ফেলে। ২০০৬ সালের দিকে বস্তি ছেড়ে রাইনখোলা এলাকায় থাকতে শুরু করে। সে সময় থেকে ইয়াবা বিক্রিতে নাম লেখায় এ দম্পতি।

    ‘গায়ে ব্লেড টেনে দেবে’

    সম্প্রতি সরেজমিন নিউসি ব্লকে গিয়ে অন্তত ১৫ জন বাসিন্দা ও বিভিন্ন দোকানির সঙ্গে কথা হয়। তারা প্রকাশ্যে ফতের মাদক সাম্রাজ্য নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, কে কী করল সেটি তাদের দেখার বিষয় নয়। এসব নিয়ে কথা বলে এলাকায় বসবাস ও রাস্তায় চলাচল অনিরাপদ করে তুলতে চান না তারা। তিন বাসিন্দা কথা বলতে রাজি হলেও নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাদের অভিন্ন ভাষ্য, ফতে ও তার বাহিনী নিউসি ব্লকের ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর রোডের সাধারণ বাসিন্দাদের কাছে আতঙ্ক। তারা এই প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করেন, আপনি এ এলাকায় অপরিচিত? ফতের লোকজন চারদিকে আছে। আপনি ফতের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন– এটি জানতে পারলে অক্ষত শরীর নিয়ে ফিরতে পারবেন না। গায়ে ব্লেড টেনে দেবে। ব্লেড দিয়ে এলোপাতাড়ি পোঁচ মারতে থাকবে। তারা আরও বলেন, মাদক হাতেনাতে না পেলে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে না। এ কারণে ফতে এখন পাইকার কিংবা খুচরা ক্রেতাদের কাছে সরাসরি নিজ হাতে ইয়াবা-হেরোইন বিক্রি করে না। ফতের নির্দেশে বড় ছেলে জয় ও তার লোকজন বেচাকেনা করে।

    একাধিক মামলার পরও ধরছে না পুলিশ

    সম্প্রতি এক রাতে নিউসি ব্লকের জল্লাদখানা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ফতের ছেলে জয় একটি কাঠের বেঞ্চে বসে সিগারেট ফুঁকছে। প্রায় প্রতি রাতে দীর্ঘক্ষণ ওই মাঠে বসে থাকে। সন্ধ্যার পর মাদক ক্রেতাদের সঙ্গে সেখানে লেনদেন করে। ফতে রাত ১০টার পর তার বাড়ির গলির মুখে একটি দোকানে মাঝেমধ্যে বসে। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বরত কর্তাদের ভাষ্য, তারা ফতেকে খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না।