মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা থেকে গত শনিবার ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় (ডিআইটিএফ) আসেন ব্যবসায়ী মোহর আলী। একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে পরিবারের সদস্যদেরও সঙ্গে আনেন তিনি। মেলা থেকে তাঁরা কার্পেট, শালসহ গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য বেশ কিছু পণ্য কেনেন। মোহর আলী বলেন, বাণিজ্য মেলায় এক স্থানে অনেক ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। পণ্যের এমন বৈচিত্র্য সচরাচর দেখা যায় না। এ জন্যই পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসা।
মোহর আলীর মতো হাজারো ক্রেতা-দর্শনার্থী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন বাণিজ্য মেলায় আসছেন। দিন যত যাচ্ছে, ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড়ও তত বাড়ছে। আর নতুন মাস শুরু হওয়ায় পণ্য বিক্রি বেড়ে গেছে। তাতে বিক্রেতারা খুব খুশি। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিনেই সবচেয়ে বেশি বেচাবিক্রি হয় বলে জানান বিক্রেতারা।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে (বিবিসিএফইসি) গত ২১ জানুয়ারি শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ২০২৪। এটি বাণিজ্য মেলার ২৮তম আসর। এবার দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৩৫১টি স্টলে তাদের পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন ও বিক্রি করছে। সাধারণত বছরের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ)। তবে জাতীয় নির্বাচনের কারণে চলতি বছর মেলা প্রায় তিন সপ্তাহ পিছিয়ে ২১ জানুয়ারি শুরু করা হয়। মাসের শেষের দিকে হওয়ায় প্রথম ১০ দিনে মেলায় ক্রেতা–দর্শনার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। এ কারণে বিক্রেতারাও কিছুটা হতাশ ছিলেন। তবে নতুন মাসের শুরু থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করায় তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছে।
বাণিজ্য মেলার প্রধান ফটকের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তারা জানান, প্রথম ১০ দিনে প্রতিদিন গড়ে ১৮ হাজার দর্শনার্থী মেলায় টিকিট কেটে প্রবেশ করেছেন। তবে নতুন মাসের প্রথম চার দিনে গড়ে ৪০ হাজার দর্শনার্থী মেলায় এসেছেন। গত শুক্রবার সর্বোচ্চ ৬৩ হাজার দর্শনার্থী মেলায় প্রবেশ করেন। দিল্লি অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবস্থাপক আব্দুল খালেক মিয়াজী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় প্রথম ১০ দিনে ৩০-৪০ শতাংশ কম বেচাকেনা হয়েছে। তবে আশা করছি, মেলার মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো সাড়া পাব।’
স্থান পরিবর্তন করে ২০২২ সাল থেকে পূর্বাচলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাণিজ্য মেলা। নতুন স্থানে প্রথম বছরে দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়নি। তবে গত দুই বছরে অনেকেই আবার পূর্বাচলমুখী হয়েছেন। এদিকে পূর্বাচলে নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের জেলার মানুষের আগমনের হার অনেক বেড়েছে।
বাণিজ্য মেলায় স্থানীয় ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস, আসবাব, টেক্সটাইল, যন্ত্রপাতি, কার্পেট, প্রসাধনী, ইমিটেশন জুয়েলারি, পাটজাত দ্রব্য, ক্রোকারিজ (তৈজসপত্র), গৃহস্থালিতে ব্যবহারের বিভিন্ন পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, স্যানিটারি সামগ্রী, খেলনা, স্টেশনারি, প্লাস্টিক পণ্য, মেলামাইন, খাদ্যসামগ্রী, টয়লেট্রিজ, প্রক্রিয়াজাত খাবার, হস্তশিল্প, গৃহসজ্জা মিলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি হচ্ছে।
সাধারণত বাণিজ্য মেলায় তৈজসপত্রসহ গৃহস্থালিতে ব্যবহারের বিভিন্ন পণ্য, পোশাক, জুতা, জুয়েলারি, হস্তশিল্প ও খেলনা প্রভৃতি পণ্যেই গ্রাহকদের বেশি আগ্রহ থাকে। মেলায় ছোট–বড় মিলিয়ে ক্রোকারিজ পণ্যের ১০-১৫টি স্টল রয়েছে। এ ছাড়া আছে একাধিক সবজি কাটার যন্ত্রের স্টল। গত শনিবার মেলায় গিয়ে এসব স্টলে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। ১৫০ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। মেলায় পোশাকের স্টলগুলোতে মেয়েদের থ্রি-পিস, শাড়ি, ওড়না, চাদর ও ছোটদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। শালসহ বিভিন্ন গরম পোশাক নিয়ে এসেছেন ভারতীয় কিছু ব্যবসায়ী। জুতা বিক্রির দেশি-বিদেশি প্রায় অর্ধশত স্টল রয়েছে; যেখানে ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায় জুতা বিক্রি হয়। মেলায় আসা গৃহিণী ফারহানা আফরোজ বলেন, ‘আমি কয়েকটি স্টল ঘুরে বিদেশি বেশ কিছু জুতা দেখেছি। জুতার মান মোটামুটি ভালোই। তবে দাম তুলনামূলক বেশি।’
পণ্য ও সেবা নিয়ে বড় প্রতিষ্ঠান
মেলায় মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশি অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও অংশ নিয়েছে। যেমন বাণিজ্য মেলায় ছোট-বড় ১০টি প্যাভিলিয়ন ও স্টলে প্রায় ৫০০ ধরনের পণ্য প্রদর্শন করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানান, পূর্বাচলে দর্শনার্থীদের আনাগোনা প্রতিবছরই বাড়ছে। এবারও মেলায় তারা শুরু থেকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রের হলরুম-এ তে রয়েছে বিভিন্ন বড় আসবাব ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের স্টল। এসব স্টলে সরাসরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। তারা মূলত গ্রাহকদের কাছে পণ্য ও সেবা প্রদর্শন করছে। যেমন ইলেকট্রনিকস কোম্পানি ওয়ালটনের স্টল ইনচার্জ সঞ্জীত গুহ বলেন, ‘আমরা কী ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পণ্য কোনগুলো—সে সম্পর্কে মেলায় আসা গ্রাহকদের জানাচ্ছি।’
মেলায় বিভিন্ন হারে ছাড় দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আসবাব প্রতিষ্ঠান হাতিলের জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক মো. জহিরুল ইসলাম জানান, তাঁরা সব ধরনের আসবাবে ৫–১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ে পণ্য বিক্রি করছেন। বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) উদ্যোক্তারাও মেলায় অংশ নিয়েছেন। এসএমই ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), জয়িতা ফাউন্ডেশন এবং জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) পৃথক চারটি স্টলে ৭৭ জন উদ্যোক্তা তাঁদের তৈরি পণ্য বিক্রি করছেন।
ব্যবস্থাপনা নিয়ে যত কথা
মেলা প্রাঙ্গণে স্টলের জিনিসপত্র ঢোকানো নিয়ে সমস্যায় পড়ছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষ মেলা প্রাঙ্গণে পণ্য প্রবেশের সময় নির্ধারণ করেছে রাত ১০টার পর থেকে। অথচ একই সময়ে মেলা প্রাঙ্গণের হলরুম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে মেলা প্রাঙ্গণে পণ্য ঢোকাতে পারলেও, তা স্টলে নেওয়া সম্ভব হয় না। আবার দিনের বেলায় পণ্য আনতে গেলে বাড়তি ভাড়া রাখে ফটকের ইজারাদারেরা। এ সমস্যার সমাধানে ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা একটি গেট করার পরামর্শ দেন তিনি।
মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন শিশুদের নিয়ে আসা মায়েরা। গত শনিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, মূল প্যাভিলিয়নের পূর্ব পাশের একটি খোলা জায়গায় এক নারী তাঁর সন্তানকে দুধ পান করাচ্ছেন। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা মানবপ্রাচীর তৈরি করে মেলার ক্রেতা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ওই সন্তানকে আড়াল করছেন।
বাণিজ্য মেলায় গত বছরের মতোই শৌচাগারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে দর্শনার্থী ও বিক্রয়কর্মীরা অভিযোগ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, মেলার অধিকাংশ শৌচাগারে পানি জমে থাকে। শৌচাগারগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। আবার বেশ কিছু শৌচাগারের দরজার লকও নষ্ট।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে মেলায় আসা স্কুলশিক্ষক আহাম্মদ আলী বলেন, নামে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হলেও ব্যবস্থাপনায় এখনো আন্তর্জাতিক মান আসেনি। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে মেলায় আসার সড়কগুলো যান চলাচলের অনুপযোগী, মেলার ভেতরে–বাইরে ধুলা আর ময়লা আবর্জনার ছড়াছড়ি। নিম্নমানের খাবার বিক্রি করা হয় চড়া দামে।
মেলায় ব্যবস্থাপনার অভিযোগ সম্পর্কে আয়োজক প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সচিব বিবেক সরকার বলেন, ‘মেলায় পণ্য প্রবেশের সময় নিয়ে উদ্যোক্তা ও ইজারাদারের সঙ্গে কথা বলে সমন্বয় করা হবে। অন্য বিষয়গুলোও আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’