বর্তমানে আধুনিক ভবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে লিফট বা এলিভেটর। সুউচ্চ ভবন এখন যেন লিফট ছাড়া আর কল্পনাই করা যায় না। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারতলার ভবনেও এখন লিফট ব্যবহার করা হয়। এভাবেই দেশে লিফটের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। তাতে বড় হচ্ছে লিফটের বাজারও। দেশে লিফটের বাজারের বড় অংশ এখনো আমদানিনির্ভর। তবে বর্তমানে দেশীয় দুই কোম্পানি ওয়ালটন ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ লিফট তৈরি ও বাজারজাত করছে। দেশীয় এসব কোম্পানি যুক্ত হওয়ায় শক্ত ভিত তৈরি হচ্ছে লিফটের বাজারে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগরায়ণের কারণে সারা দেশেই আবাসন খাত বড় হচ্ছে। দেশের আবাসন খাত নিয়ে ২০১৮ সালে একটি জরিপ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) আবাসন খাতের অবদান প্রায় পৌনে ৮ শতাংশ। বছর বছর সেই অবদান আরও বাড়ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ অনেক বেড়েছে। তাতে বাড়ছে লিফটের চাহিদাও।
বৈশ্বিক বাজার যেমন
লিফটেড: দ্য কালচারাল হিস্ট্রি অব দ্য লিফট বইয়ের লেখক আন্দ্রেয়াস বার্নার্ড বলেন, লিফট আবিষ্কারের আগে ভবনের সবচেয়ে ওপরের তলা ছিল বসবাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ জায়গা। সে সময় গৃহকর্মীদের অবস্থান হতো ওপরের তলায়। তবে লিফটের আবিষ্কার যেন সবকিছু বদলে দিয়েছে। হঠাৎ করেই বহুতল ভবনের ওপরের তলাগুলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
১৮৫৯ সালে নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউ হোটেলে বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী লিফট স্থাপন করা হয়। এর পরবর্তী কয়েক দশকে প্রযুক্তিটি বাণিজ্যিক অফিস ও আবাসিক ভবনে ছড়িয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লিফটের প্রযুক্তিতেও এসেছে নানা পরিবর্তন। ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে লিফটের বৈশ্বিক বাজার ছিল ৮ হাজার ৩৮৬ কোটি ডলারের। ২০৩০ সাল নাগাদ এই বাজার ১৪ হাজার ২৫২ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। লিফটের বৈশ্বিক বাজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশের বেশি।
দেশে বাড়ছে চাহিদা
লিফটের উৎপাদক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা জানান, দেশে বর্তমানে প্রতিবছর সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার লিফট বেচাকেনা হয়। অর্থের হিসাবে এই বাজার প্রায় এক হাজার কোটি টাকার। গত কয়েক বছরে লিফটের বাজারে ৫-১০ শতাংশ হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে দেশের লিফটের বড় বাজার এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। প্রায় ৪৫ শতাংশ লিফট বিক্রি হয় ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়। আর ২০ শতাংশ বিক্রি হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এ ছাড়া কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহীতেও লিফটের বড় বাজার রয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঢাকার পূর্বাচল আবাসন প্রকল্প ও দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকারখানা নির্মাণ শুরু হলে লিফটের বাজারে আরও গতি আসবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণের পর বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলেও বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প ও বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে এই দুই অঞ্চলেও লিফটের বাজার বাড়বে বলে আশা তাঁদের।
আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল বলেন, দেশে লিফট উৎপাদনে একাধিক বড় কোম্পানি যুক্ত হয়েছে। এসব কোম্পানির তৈরি লিফটের প্রতি গ্রাহকের আস্থা দিন দিন বাড়ছে। এতে লিফটের বাজারও জ্যামিতিক হারে বড় হচ্ছে। এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে এই খাতে আমদানিনির্ভরতা কমে আসবে। তখন দেশ থেকে লিফট রপ্তানিও সম্ভব হবে।
কমছে আমদানিনির্ভরতা
বর্তমানে চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লিফট দেশে তৈরি হয়। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এই অবস্থান তৈরি করেছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। এই হিস্যা প্রতিবছর বাড়ছে; ফলে কমতে শুরু করেছে আমদানিনির্ভরতা। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বর্তমানে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান লিফট আমদানি করে। তবে সব ধরনের নিয়মনীতি মেনে লিফট আমদানি, বাজারজাত ও বিক্রয়োত্তর সেবা দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০–এর বেশি নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মান বাংলাদেশ, তাসিনকো, এনার্জি প্যাক, ইউরো লিফট বিডি, ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স প্রভৃতি। তারা মূলত চীন, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো থেকে লিফট এনে বিক্রি করে।
লিফট উৎপাদনকারী দেশীয় নিবন্ধিত দুই কোম্পানি হচ্ছে ওয়ালটন ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। এর মধ্যে ২০১৯ সালে লিফটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে ইলেকট্রনিক খাতের শীর্ষস্থানীয় দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। বর্তমানে ৩০০ কেজি থেকে শুরু করে ৫ হাজার কেজি ধারণক্ষমতার লিফট তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়ালটনের কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ওয়ালটনের লিফটে ১৫টির মতো নিরাপত্তা ডিভাইস যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে রয়েছে বিক্রয়–পরবর্তী সেবার সুযোগ।
এ ছাড়া তিন দশকের বেশি সময় ধরে লিফট আমদানি করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। তারা ২০২০ সালে লিফট সংযোজন ও উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে ‘প্রোপার্টি লিফট’ ব্র্যান্ড নামে লিফট বাজারজাত করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে উন্নত প্রযুক্তির লিফট তৈরি করছেন। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে যন্ত্রপাতি সংযোজন করে লিফট বানিয়ে বিক্রি করছে স্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণকাজ যত বাড়বে, লিফটের ব্যবহারও তত বাড়বে।
দরদাম ও মান যেমন
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের লিফট পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে প্যাসেঞ্জার, কার্গো, হাইড্রোলিক কার লিফট, সিজার, হোম, হাসপাতাল ও ক্যাপসুল ধরনের লিফট। এসব লিফট বাসাবাড়ি, বহুতল বিপণিবিতান, হাসপাতাল ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশীয় উৎপাদক কোম্পানিগুলো বর্তমানে সব ধরনের লিফটই তৈরি করছে।
দেশে মোটামুটি ১০-১৫ লাখ টাকা থেকে কোটি টাকার মধ্যে লিফট কিনতে পাওয়া যায়। তবে মানভেদে দামও ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন ১০ তলা ভবনের জন্য ওয়ালটনের ৬৩০ কেজি ওজনক্ষমতার একটি লিফটের দাম ২৫-২৬ লাখ টাকা। দেশে উৎপাদিত লিফটের দাম আমদানি করা লিফটের তুলনায় ৩-৪ লাখ টাকা কম। তবে স্থানীয় অনেক কোম্পানি যথাযথ মান নিশ্চিত না করে লিফট তৈরি ও সরবরাহ করছে বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ভবনের বাসিন্দাদের ওঠানামার জন্য ব্যবহৃত লিফটের ফিটনেস বা নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর তেমন তদারকিও দেখা যায় না।
ওয়ালটন লিফটের ব্র্যান্ড ম্যানেজার জাকিবুর রহমান বলেন, লিফট কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এর নিরাপত্তা ও বিক্রয়–পরবর্তী সেবা। বর্তমানে দেশে অনেক ভুঁইফোড় কোম্পানি নিরাপত্তা যন্ত্র ও বিক্রয়–পরবর্তী সেবা ছাড়া কম মূল্যে লিফট বিক্রি করছে। ফলে মানহীন এসব লিফটের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
prothomasha.com
Copy Right 2023